আনন্দ বাউরি। ছবি: লেখক
গ্রামজ সংস্কৃতির গর্ভজাত সেই সংস্কৃতি ছিল রাঢ়বঙ্গের মানুষের বারো মাসে তেরো পার্বণের সঙ্গী। সে সব গান, পালাগান, ব্রতকথা সে সময় গ্রামীণ সমাজের কৃষিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হত। কৃষিকে কেন্দ্র করে মানুষের আর্থিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রটিও প্রসারিত হত এই ভাবে। একদা সমৃদ্ধির প্রতীক সেই লেটো গান, বালক সঙ্গীত, কাঠিনাচই এখন মৃতপ্রায়।
সেই রকমই কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া লোক সংস্কৃতির অমূল্য উপাদান হল রাঢ় বাঁকুড়ার বালক সঙ্গীত। ঐতিহ্যগত ভাবে ও ভৌগোলিক দিক থেকে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষজনই এই লুপ্তপ্রায় বালক সঙ্গীতের মূল কারিগর। পরবর্তীতে যূথবদ্ধ প্রয়াসে লোকজ পালাগানগুলি পুষ্ট হয়েছিল। এক সময় কৃষিভিত্তিক গ্রাম্য জীবনে দিনান্তে ঘরে ফেরার বেলায় অবসর সময়ে নির্ভেজাল সাংস্কৃতিক চর্চায় মেতে উঠত গ্রামীণ অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষজন। উল্লেখ্য আদি-মধ্যযুগেও এই ধরনের পালাগানগুলি বাংলায় প্রচলিত ছিল। জয়দেবের গীতগোবিন্দ এবং মধ্যযুগীয় কবি বড়ু চণ্ডীদাস রচিত রাধাকৃষ্ণের প্রণয়কথা বিষয়ক আখ্যান কাব্যগুলি জনপ্রিয় ছিল। রাগ এবং লোকসঙ্গীতের সমন্বয়ে সেই সময় বাংলায় ভক্তিবাদী কীর্তন গানের ধারা প্রবর্তিত হয়েছিল। তারই হয়ত একটি লোকজ শাখা বালক সঙ্গীত।
রাঢ় বাঁকুড়ার একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিমণ্ডল থেকে এই বালক সঙ্গীতের উদ্ভব। বালক সঙ্গীত হল কীর্তন ঢঙের এক ধরনের পালাগান। একদা গ্রামে গ্রামে যার সমাদার ছিল। বালক সঙ্গীতের বিভিন্ন দল থাকত। প্রত্যেক দলে ৩০ থেকে ৩৫ জন অভিনয় করতেন। সঙ্গীত এবং বাদ্যশিল্পীরাও থাকতেন সঙ্গে। উল্লেখযোগ্য পালাগুলি ছিল, ‘নৌকা বিলাস’, ‘কংসবধ’, ‘মাথুর’, ‘নিমাই সন্ন্যাস’, ‘কালিয়া দমন’, ‘মান পালা’, ‘সুবল মিলন’ প্রভৃতি।
প্রাক্তন বালক সঙ্গীত শিল্পী আনন্দ বাউরি এক আলাপচারিতায় হারিয়ে যাওয়া বালক সঙ্গীতের সেই স্বর্ণালি দিনগুলির কথা মনে করলেন। জানালেন, পিতা প্রয়াত উমাপদ বাউরিই ছিলেন তাঁর বালক সঙ্গীতের গুরু। বাকি সারাজীবন এই সঙ্গীতকে যাপন করার আকাঙ্ক্ষা নেহাতই সঙ্গীতের প্রতি অদম্য ভালবাসা থেকে। পুরনো দিনের কথা মনে করতে গিয়ে গেয়ে উঠলেন ‘আমি রাধারও লাগিয়া সেজ বিছাইনু গাঁথিনু ফুলের মালা....বিফল হইল মালা/ গেল গেল মালা বিফলে গেল আমার কোন কাজে লাগল না গো..’। স্মৃতিচারণায় জানালেন, সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর যখন সন্ধ্যা চুঁইয়ে পড়ত সবুজ সুন্দর গ্রামীণ জীবনে, সেই কয়েক ঘণ্টার অবসর সময়েই এমন নিখাদ সংস্কৃতির মহড়া চলতে থাকত প্রত্যন্ত রাঢ় বাংলায়। আনন্দে, গানে, মশকরায় মেতে উঠতেন সবাই।
বাঁকুড়ার জেলার বড়জোড়া ব্লকের অন্তর্গত দধিমুখা গ্রামেও এমন এক বালক সঙ্গীতের দল ছিল। আজ যদিও তার কোনও অস্তিত্ব নেই। জানা যায়, গ্রামের বালক সঙ্গীত দলের সদস্যদের সান্ধ্য বৈঠক থেকেই শুরু হত মহড়া। কেউ সাজতেন কৃষ্ণ, রাধা, কেউবা কুটিলা, জটিল্ যশোদা, নন্দরাজ, বলাই-কানাই কিংবা সখি ললিতা। এক এক একটি পালার জন্য ৩০ থেকে ৩৫ জনের দল গঠন করা হত। প্রত্যেকেই হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে মহড়া দিতে জড়ো হতেন। মহড়া চলত।
চূড়ান্ত অনুষ্ঠানের দিনগুলিতে কেউবা সাজপোশাক পরাতে, কেউ মেক আপের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। এই ভাবে দলগত কাজের ভাগ থাকত। পুরুষদের নারী সাজাতে প্রয়োজনীয় সাজ পোশাকের ব্যবস্থা ছিল। কারণ সেই সময় নারীর চরিত্রে পুরুষরাই অভিনয় করত। গলার স্বর ও অঙ্গভঙ্গিমার নিখুঁত বদলে পালা মঞ্চস্থ হত। পরবর্তী কালে দধিমুখার বালক সঙ্গীতদলে মেয়েরাও অভিনয়ে যোগ দিয়েছে বলে জানান প্রাক্তন শিল্পী আনন্দ বাউরি।
বেশ কিছু দিন মহড়ার পর বিভিন্ন উৎসব-পরবকে কেন্দ্র করে গাইনের (বালক সঙ্গীতের) দল বাইনা (বুকিং) ধরতেন। যেখানে যেমন পালার বাইনা অগ্রিম বুকিং করা থাকত, সেই অনুযায়ী বালক সঙ্গীত মঞ্চস্থ হত। পেশাদার ও অপেশাদার উভয় দলই ছিল। না, নাম করা কোনও অর্কেস্ট্রা নয়, বালকসঙ্গীত মঞ্চস্থের জন্য যা যা প্রয়োজনীয় প্রথম দিকে স্থানীয় ভাবেই তা সংগৃহীত হত। সাজসজ্জা, অভিনয়ের জন্য শিল্পীদের ওড়না থেকে পড়চুল সাজকোজের সবই মজুত রাখতে হত দলকে। সেসবও ছিল সংগৃহীত। রঙিন পোশাক পরে অভিনেতা অভিনেত্রীরা সহজপ্রাপ্য বিভিন্ন রঙ চরিত্র হয়ে উঠতেন ক্রমে। বাদ্যযন্ত্র বলতে ছিল ঢোল, হারমোনিয়াম, আড়বাঁশি, করতাল ও ঝুনঝুনি প্রভৃতি। কাহিনি আর সঙ্গীতের সুর মূর্ছনায় এক নান্দনিক পরিবেশ গড়ে উঠত। কখনও অভিনয়ের ভাষায় কিংবা সঙ্গীতের শব্দ ছন্দে গীতিময় হয়ে উঠত সান্ধ্য জলসা। এমন নির্ভেজাল লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রাতভোর চলত।
সেই বালক সঙ্গীতের কোনও লিখিত ছাপানো সংলাপের বই ছিল না। তবে খাতায় লিখে রাখা হত কাহিনি সংলাপ। সহজাত লোক কাব্যের উপর ভরসা করেই মুখে মুখেই তৈরি হয়েছিল সেই সময় গানের ভাষা। নেচে, গেয়ে পালা গান মঞ্চস্থ হত।
বালক সঙ্গীত আজ আর্থসামাজিক কোপে বিদীর্ণ। বর্তমানে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে পালাগান বালক সঙ্গীতের দলগুলি। রুটিরুজির সন্ধানে আজ তারা বিচ্ছিন্ন। আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের অকৃত্রিম গ্রামজ সংস্কৃতি হারিয়ে গিয়েছে। চটুল সংস্কৃতির উৎপাত, সরকারি অনুগ্রহের কার্পণ্য কিংবা কুলিন শিল্পীদের অহংকার অন্ত্যজ শ্রেণির এই লোকজ সংস্কৃতি বালক সঙ্গীতকে কখনও জাতে উঠতে দেয়নি। আজও এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনওরকম গবেষণা বা চর্চা হয়েছে বলে কলমচির জানা নেই। কোনও পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করা গেল না। অবহেলা আর অবজ্ঞায় কী হারিয়ে গেল রাঢ় বালক সঙ্গীত। যা হতে পারত লোকসংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ, দুর্লভ উপাদান।
লেখক নজরুল শতবার্ষিকী বিদ্যালয়ের শিক্ষক