রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের অধিক নিয়ন্ত্রণকে স্বাগত জানাইয়াও কিছু প্রশ্ন রহিয়া যায়।
সমবায় ব্যাঙ্কগুলিকে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের অধীনে আনিতে অধ্যাদেশ জারি করিল কেন্দ্র। ইহার ফলে সমবায় ব্যাঙ্কগুলির উপরে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ বাড়িবে। উদ্দেশ্য সাধু— আর্থিক গোলযোগ ও দুর্নীতি প্রতিরোধ। কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত অপ্রত্যাশিত নহে। আর্থিক কেলেঙ্কারি কখনওই সমবায় ব্যাঙ্কগুলির পিছু ছাড়ে নাই, গত কয়েক বৎসরে বেশ কয়েকটি সমবায় ব্যাঙ্ক প্রায় ডুবিতে বসিয়াছে। মহারাষ্ট্র ও পঞ্জাব সমবায় ব্যাঙ্ক (পিএমসি ব্যাঙ্ক) একটি বেসরকারি সংস্থাকে অবৈধ উপায়ে চার হাজার কোটি টাকারও অধিক ঋণ দিয়াছিল। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক রাশ টানিয়াছে, কিন্তু ব্যাঙ্কটির ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত। চলতি বৎসরে চল্লিশটিরও অধিক ব্যাঙ্ককে নানা ভাবে সংযত করিয়াছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক, আর্থিক দুর্দশা অথবা অনিয়ম সামলাইতে। খাতায় কলমে সমবায় ব্যাঙ্কগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে দুইটি প্রতিষ্ঠান, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এবং রাজ্য সরকারের সমবায়ের রেজিস্ট্রার। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের উপর যে পর্যায়ে নজরদারি করিয়া থাকে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক, সমবায় ব্যাঙ্কগুলির উপর তাহা পারে না। অপর দিকে, সমবায় ব্যাঙ্কগুলি কখনও রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হইতে পারে নাই। প্রায় সকল রাজ্যে দেখা গিয়াছে যে অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে ঋণ দিবার ফলে অনাদায়ী ঋণের বোঝা বাড়িয়াছে, ব্যাঙ্ক রুগ্ন হইয়াছে, বিপন্ন হইয়াছেন গ্রাহক। যদিও বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির তুলনায় সমবায় ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ী ঋণের অনুপাত এখনও কম।
বাজারের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে অদক্ষ, অলাভজনক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হইবে, ইহাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমবায় ব্যাঙ্ককে কেবল বাণিজ্যের নিরিখে দেখা সম্ভব নহে। গ্রামীণ গ্রাহক, দরিদ্র ও স্বল্পবিত্ত, কৃষিজীবী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পাইবার প্রধান উপায় সমবায় ব্যাঙ্ক। জেলাগুলিতে সহজ শর্তে ক্ষুদ্র ঋণের চাহিদা এতই অধিক, ও তুলনায় বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের উপস্থিতি এতই কম, যে সমবায় ব্যাঙ্কই ভরসা। সেগুলি দরজা বন্ধ করিলে ঋণের সুযোগ কমিবে, বহু স্বল্পবিত্ত গ্রাহক শেষ সঞ্চয়ও হারাইবেন। সামাজিক বিপর্যয় এড়াইতেই বারবার সরকারি অর্থে সমবায় ব্যাঙ্ক বাঁচানো হইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্ক তাহার উদাহরণ। একশো কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণ জমিবার পরে ২০১৪ সালে ব্যাঙ্কটির লাইসেন্স বাতিল করিয়া দেয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। রাজ্য ও কেন্দ্র ১১১ কোটি টাকার প্যাকেজ দিয়া তাহাকে পুনরুজ্জীবিত করে। তাহাতে দুই লক্ষ সত্তর হাজার গ্রাহকের ক্ষুদ্র সঞ্চয় বাঁচিয়াছিল। বীরভূমের এই ব্যাঙ্ক-সহ মোট তেইশটি ব্যাঙ্ককে পুনরায় কার্যকর করিতে কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয় করিয়াছিল। করদাতার অর্থ বাঁচাইতেই অধিক নজরদারি প্রয়োজন।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের অধিক নিয়ন্ত্রণকে স্বাগত জানাইয়াও কিছু প্রশ্ন রহিয়া যায়। তাহার একটি রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সাধ্যের সীমা লইয়া। বৃহৎ শহরের গুটিকয় সমবায় ব্যাঙ্কই পরীক্ষিত হইবে, গ্রামীণ ব্যাঙ্কগুলি উপেক্ষিত হইবে, এই ভয় রহিয়া যায়। এ দেশের ৯২ হাজার কৃষি সমবায়ও সমবায় ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার অন্তর্গত। সেগুলিকে কার্যকর করা প্রয়োজন। অপর প্রশ্নটি অনাদায়ী ঋণ আদায় লইয়া। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির বিপুল বকেয়ার বোঝা জমিয়াছে, পুনরুদ্ধারে সাফল্য মেলে নাই। সমবায় ব্যাঙ্কে মিলিবে কি?