অসহিষ্ণু অহংকার, যা স্বভাবত আত্মঘাতী

চুপ করে থাকা অসম্ভব

ডেঙ্গির প্রকোপ স্বীকার করা-না-করা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রবাহিত হয়েছে অনন্ত সওয়াল-জবাব, অগণন রঙ্গরসিকতা এবং, অধুনা যা অবধারিত, সোশ্যাল মিডিয়ার অমিত প্রগল্‌ভতা।

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

যুদ্ধ: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সদর দফতর নবান্ন-র চার পাশে মশা তাড়ানোর কাজ চলছে। ২৫ অক্টোবর। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

প্রায় একশো বছর আগে দার্শনিক লুডউইগ উইটগেনস্টাইন তাঁর দর্শন বিষয়ক একটি গ্রন্থের মুখবন্ধে লিখেছিলেন, ‘‘যে কথা আদৌ বলা যায় তা পরিষ্কার করে বলা যায়, এবং যা বলা যায় না সে বিষয়ে নীরব থাকতেই হবে।’’ অমর্ত্য সেন দি আইডিয়া অব জাস্টিস বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের শুরুতে ওই উক্তি উদ্ধৃত করেছেন, সেই সূত্রেই কথাটা জেনেছি। এবং জানার পর থেকে, কোনও বিষয়ে কিছু বলার ইচ্ছে হলে অনেক সময়েই থমকে গিয়ে ভেবেছি— ষোলো আনা পরিষ্কার করে বলতে না পারি যদি, নীরব থাকাই উচিত বোধহয়। তবে, অমর্ত্য সেন অভয় দিয়ে জানিয়েছেন, সেই অসামান্য দার্শনিক নিজেই তাঁর সুকঠোর নীতি সর্বদা মেনে চলেননি, পরে সেই নীতি সংশোধনও করেছিলেন। ভালই করেছিলেন, না হলে শেষ পর্যন্ত কেউ কোনও কথাই বলে উঠতে পারত না।

Advertisement

২০১৭ সালের অলীককুনাট্যরঙ্গময় পশ্চিমবঙ্গে বসে উইটগেনস্টাইনের কথা মনে পড়াটা একটু বিসদৃশ ঠেকতে পারে, কিন্তু গত কিছু দিন ধরে ডেঙ্গি নামক ব্যাধিটিকে ঘিরে যে বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহ চলেছে, তাতে কথা বলা এবং নীরব থাকার এই দ্বৈতবাদ নিয়ে ভাবনাটাকে রুখতে পারছি কই? যত দিন যাচ্ছে, ততই শুনছি, ডেঙ্গি অত্যন্ত গোলমেলে ব্যাপার, তার গতিপ্রকৃতি প্রায়শ অনিশ্চিত এবং রহস্যময়, রোগনির্ধারণ থেকে চিকিৎসার পদ্ধতি, কিছুই সহজ সরল নয়, আর তাই সংক্রমণের আভাস পেলেই রোগের লক্ষণ, রক্তপরীক্ষার ফল, রোগীর শারীরিক অবস্থা, সব কিছু লাগাতার তদারক করতে হবে, এমনকী আপাতদৃষ্টিতে রোগীর অবস্থায় উন্নতি হওয়ার পরেও নজরদারিতে ঢিলে দিলে চলবে না, জ্বর কমার পরে বরং সতর্কতা আরও বাড়াতে হবে। তার মানে, ব্যাধি এবং চিকিৎসা, দুটো বিষয়েই যান্ত্রিক ভাবে, অঙ্ক মেনে সিদ্ধান্ত ঘোষণার জো নেই। তা হলে উপায়? ‘পরিষ্কার’ বলা না গেলে নীরব থাকাই শ্রেয়?

উইটগেনস্টাইন, ভরসা রাখি, তেমনটা বলতেন না। বরং ‘যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বোলো না’ বলে মশা মারতে পাঠাতেন। এবং অমর্ত্য সেন, নিশ্চিত জানি, পরামর্শ দিতেন, ‘‘যতটুকু জানা যাচ্ছে, সেটাই তো এই ব্যাধির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণার পক্ষে যথেষ্ট কারণ বলে মনে করি। এ সব ব্যাপারে নীরবতা কেবল অনুচিত নয়, ঘোর অন্যায়। যে যত জোরে পারে এ নিয়ে কথা বলা দরকার, যাতে ওই যুদ্ধটা জারি হয় এবং জারি থাকে।’’

Advertisement

অথচ, মুশকিল হল, রোগব্যাধির বিরুদ্ধে যাঁদের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা, তাঁরাই এ ব্যাপারে বিচিত্র আচরণ করে চলেছেন। রাজ্য সরকার এবং পুর প্রশাসন কোথায় ডেঙ্গির মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, নাগরিকদেরও সেই লড়াইয়ে পূর্ণ উদ্যমে শরিক হতে বলবেন, ইচ্ছে হলে খানকয়েক রণসংগীত বেঁধে মোড়ে মোড়ে বাজাতে থাকবেন, বস্তুত ডেঙ্গি নামক চ্যালেঞ্জটাকে একটা সুযোগে রূপান্তরিত করবেন— রাজ্য জুড়ে এক বিপুল সাফাই অভিযানের সুবর্ণসুযোগ, যাতে বাঙালির রোগ কমে, দলের ভোটও বাড়ে— তা নয়, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী রায় দিলেন— ডেঙ্গি নিয়ে বাড়াবাড়ি হচ্ছে, সমঝে চলুন, না হলে ফল ভাল হবে না! দিকে দিকে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে: ডেঙ্গি দেখব না, ডেঙ্গি শুনব না, ডেঙ্গি বলব না। স্বাস্থ্যকর্মী থেকে মন্ত্রী-সান্ত্রি সবাই ভয়ে অস্থির, এমনকী নিজের বাড়িতে রোগ ধরা পড়লেও নাকি তাঁরা করুণ মুখে পরস্পর বলছেন, ‘চিকিৎসা যা করানোর করছি, কিন্তু অসুখের নামধাম নিয়ে হইচই না করাই ভাল, সবই তো বোঝেন...’

ডেঙ্গির প্রকোপ স্বীকার করা-না-করা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রবাহিত হয়েছে অনন্ত সওয়াল-জবাব, অগণন রঙ্গরসিকতা এবং, অধুনা যা অবধারিত, সোশ্যাল মিডিয়ার অমিত প্রগল্‌ভতা। বাঙালি সব হারিয়েছে, হারায়নি কেবল তার অতিকথনের স্বভাব। তবে তাতে এ-জাতির বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি নেই, কিছু না কিছু নিয়ে তার কথাসরিৎসাগরে তুফান চলতই। বিপদ অন্যত্র। রোগ চেপে রাখলে সারে না, বাড়ে। সংক্রামক ব্যাধির বেলায় সমস্যা আরও গভীর। তার হিসেবপত্র ঠিক ঠিক না রাখলে এবং সমস্ত স্তরে নিয়মিত সে হিসেব না জানালে সংক্রমণের চরিত্র বুঝতে ভুল হয়— কোন এলাকায় ব্যাধির কতটা বিস্তার ঘটছে, জীবাণু কোথায় কী ভাবে নিজেকে পালটে ফেলছে, তার ঠিক ঠিক হদিশ পাওয়া যায় না, আর সে-সব তথ্য জানা না থাকলে ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াইটাও ঠিক ভাবে লড়া যায় না। মনে রাখতে হবে, এই লড়াই এক বছরের নয়, প্রতি বছরের, এবং সারা বছরের। এ বছরের তথ্য-পরিসংখ্যান যদি ঠিক ঠিক না থাকে, পরের বছরের লড়াই আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে, পরিস্থিতি আরও সঙ্গিন। তখন হয়তো ‘ডেঙ্গি’ উচ্চারণ করলেই শূলে চড়ানো হবে, কিন্তু তাতে মশাও মরবে না, রোগও সারবে না।

প্রশ্ন হল, এই সমস্যাগুলো বুঝতে কাণ্ডজ্ঞানের বেশি কিছু তো লাগে না, তা হলে প্রশাসনের এমন আচরণ কেন? বিশেষত কেউই যখন বলেনি যে, সরকার বা পুরসভা ইচ্ছে করে ডেঙ্গি ছড়িয়েছেন! সংক্রমণ প্রতিরোধে তাঁদের আরও অনেক বেশি সজাগ এবং সক্রিয় হওয়া উচিত ছিল-এই সমালোচনা তাঁদের শুনতেই হত। কিন্তু সে তো এখন আরওই শুনতে হচ্ছে। আর, এ সব সমালোচনা তো এ দেশে কবেই গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে!

তবে কি সবটাই নিছক অসহিষ্ণু অহংকার? যে অহংকার বলে, ‘আমিই ঠিক এবং আমি সব সময় ঠিক’? কেন ঠিক, ঠিক মানে কী, সে প্রশ্ন শুনতেও সে নারাজ, কারণ শুনলেই ভিন্নমতের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়, আর তাতেই তার মহিমায় টোল পড়ে। এই অহংকারের অসহিষ্ণুতা তাই এক অর্থে নির্ভেজাল, আপসহীন। তার সঙ্গে তর্ক চলে না, এমনকী আলোচনার দরজাও সে মুখের ওপর বন্ধ করে দেয়। দিয়ে, শেষ পর্যন্ত নিজেরই ক্ষতি করে সে, কারণ ভুল স্বীকার না করলে ভুল সংশোধনের পথ বন্ধ থাকে। কিন্তু তা জেনেও সে ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়’ বলে আপন অভিমানে অনড় থাকে। অহংকার কি স্বভাবত আত্মঘাতী?

হাতে রইল প্রশ্নগুলোই। উত্তর জানি না। সব প্রশ্নও হয়তো খুব পরিষ্কার নয়। যে প্রশ্ন পরিষ্কার নয়, তা উচ্চারণ করা কি উচিত? কী জানি। তবে একটা কথা মনে পড়ল। ১৭৮৯ সালের ৫ মে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ওয়ারেন হেস্টিংসের ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব নিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন এডমন্ড বার্ক। ভাষণের উপক্রমণিকায় তিনি ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে হেস্টিংসের অনাচার সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘একটি ঘটনা ঘটেছে, এমন ঘটনা যা নিয়ে কিছু বলা কঠিন, এবং চুপ করে থাকা অসম্ভব।’’

ঠিকই। বলা যত কঠিনই হোক, চুপ করে থাকা অসম্ভব।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement