সহিংস। অধুনা বিতর্কিত টিপু সুলতানের প্রিয় খেলনা: ভারতীয় বাঘের কামড়ে ইংরেজ সৈন্যের বেহাল দশা।
ঐতিহাসিক বিতর্কের উপর স্ক্রিপ্টগুলি সব কেমন পুরনো বলে মনে হয়। হিঁদুর গরুর মাংস খাওয়া বা না-খাওয়া নিয়ে তর্ক, বা টিপু সুলতানের উপর যাত্রাপালা, কিছুই নতুন নয়। এ সব মাঝে মাঝেই শোনা গেছে, দেখাও হয়েছে। গো-রক্ষা বা গো-মাতা সংরক্ষণ আন্দোলন তো উনিশ শতকের শেষে উত্তরপ্রদেশে তুলকালাম করেছিল। ১৯৩০-এর দশকও বাদ যায়নি। স্বাধীন ভারতেও একরাশ কমিশন বসেছিল, ষাটের দশকে বিখ্যাত নন্দ কমিশনের কথা এখনই মনে আসছে। টিপুকে নিয়ে ভারতীয় দূরদর্শন ভগবান গিদওয়ানির উপন্যাস দি সোর্ড অব টিপু সুলতান-এর উপর নির্ভর করে ছবি তৈরি করেছিল। স্বদেশপ্রেমিক, ধর্মনিরপেক্ষ শাসক হিসাবেই টিপু সেই সিরিয়ালে হাজির হন। ব্যস, ভারতীয় জনতা পার্টি খেপে যায়, বিক্ষোভ হয়, ১৯৯০-তে সিরিয়ালটি বন্ধ করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট থেকে নিষেধাজ্ঞা আনার আবেদন করা হয়, আবেদনটি নাকচ হয়। অভিযোগ একই: ইতিহাসের বিকৃতি, হিন্দুরা ক্ষুব্ধ। টিপু ধর্মান্ধ সুলতান, সুযোগমাফিক বিধর্মী হিন্দু ও খ্রিস্টানদের নিকেশ করেছিলেন।
এ বারের বিতর্কটি চড়া। বিক্ষোভের সময় সরকারি পুলিশের গুলিতে দুই নাগরিকের মৃত্যু ঘটনার পালাকে বিষয়টিকে পৌনঃপুনিকতায় নিয়ে গেছে, তার মধ্যে গিরিশ কারনাডের আলগা মন্তব্যও তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। জনপরিসরে অতীতের ‘হিরো’র স্মৃতি উদ্যাপনের রাজনীতি সমস্যাসঙ্কুল। দেশ-কাল-পাত্র ভেদে কারও কারও কপাল কমবেশি পোড়া। যেমন, বিদেশের কলম্বাস বা ক্লাইভ আর স্বদেশের প্রতাপাদিত্য, সিরাজ বা টিপু। তবে, ২০১৫ সালটার দিনগুলি গরম, কর্নাটকেই সামান্য কিছু দিন আগে কালবুর্গির মতো প্রতিথযশা বুদ্ধিজীবী নিহত হয়েছেন, দেশ জুড়ে চলছে সহিষ্ণুতা নিয়ে ঝোড়ো বিতর্ক। মহাভারতীয় উদ্যোগ পর্বের অবস্থা। নিজেদের দাবির ন্যায্যতায় পাণ্ডব ও কৌরবের মতো উভয় পক্ষই অনড়।
এই অবস্থায় ঐতিহাসিকদের একটু মান বাড়ে। এমনিতে ঐতিহাসিকদের ভারী ভারী লেখা কেউ একটা পড়ে না, তবে এই ধরনের বিতর্কে মন্তব্য করার জন্য তাঁদের ডাক পড়ে। টিপুর কর্মকাণ্ড নিয়ে চাপান-উতোর চলেই আসছে। ইতিহাসবিদ সুরেন্দ্রনাথ সেন দেখিয়েছিলেন: ভবানীর বরপুত্র মরাঠা সৈন্যরা রঘুনাথ রাও পটবর্ধনের নেতৃত্বে শৃঙ্গেরি মঠ লুঠ করেছিল, শারদা দেবীমূর্তিও ভেঙেছিল। ‘জগৎগুরু’ বলে মঠাধীশকে সম্বোধন করে সুলতান টিপু মঠ সংস্কার করেন। কেবল মঠই নয়, কর্নাটকের নানা শৈব মন্দির টিপুর দানে পুষ্ট। সে যুগের রীতি অনুযায়ী টিপুর মন্ত্রীর ও রাজস্ব সচিবরা ছিলেন হিন্দু। পূর্বতন রাজ্যচ্যুত হিন্দু রাজপরিবারের প্রথামত দসেরা উৎসব নিয়মিত পালিত হত। হোয়সল রাজাদের নানা রাজচিহ্ন টিপু গ্রহণ করেছিলেন, এমনকী মৃত্যুর দিনও যুদ্ধে যাওয়ার সময় হিন্দু জ্যোতিষীদের নির্দেশিত আচার মানতে তিনি দ্বিধা করেননি।
ইতিহাসবিদরা এ-ও জানিয়েছেন যে, প্রশাসন ও অর্থনীতিতে টিপু আধুনিক সংস্কার এনেছিলেন। মহীশূরের সীমানার বাইরে এশীয় ও ইউরোপীয় জগৎ সম্পর্কে তাঁর সক্রিয় আগ্রহ ছিল। এ সবের সঙ্গে ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে একরোখা জেহাদ। বাবা হায়দর আলিও নাকি তাঁকে বোঝাতে পারেননি। একটি বাঘ সগর্জনে এক ইংরজেকে মারছে, আর ইংরেজ আর্তনাদ করছে— এটাই ছিল টিপুর প্রিয় খেলনা। একেবারে অর্ডার মাফিক তৈরি। শ্রীরঙ্গপত্তন গুঁড়িয়ে দিয়ে ইংরেজরা খেলনাটাকে নিয়ে গিয়ে লন্ডনের মিউজিয়মে মূঢ় ভারতীয় নরপতির খোয়াবনামার স্মারক হিসেবে সাজিয়ে রাখে। ইংরেজ সিংহের কাছে ভারতীয় শের-রা ইঁদুরের মতোই তুচ্ছ— টিপুকে ঘিরে এই বার্তা সাম্রাজ্যের ইতিহাসে গেঁথে গিয়েছিল।
এ সবের ফাঁকে ফাঁকে অন্য কথাও আছে। সনাতনী শাসক ওয়াদের রাজবংশকে সরিয়ে হায়দর আলি ও টিপু সুলতান মহীশূর দখল করেছিলেন। কুর্গ-এর পলিগার বা সামন্তরা তাঁদের আধিপত্য মানেনি, বিদ্রোহ জারি রেখেছিল। টিপুও ওই অঞ্চলকে ছারখার করেছিলেন। অর্থশাস্ত্রের রীতি অনুযায়ী হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বিদ্রোহী প্রজাদের উৎখাত করেছিলেন। বেশি টেটিয়া যারা, তাদের ধর্মান্তরও হয়েছিল। বিদ্রোহী প্রজার ধর্মবিচার ধর্তব্যে পড়ে না। অশীন দাশগুপ্তের গবেষণায় জানা যায় যে, দ্রুত রাজস্ব তোলার তাগিদে ও কোম্পানির বাণিজ্য ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে টিপুর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ মালাবারের ইহুদি দেশজ বণিকদের দম বন্ধ করে দিয়েছিল। ত্রাহি মধুসূদন বলে কোম্পানিকেই তারা স্বাগত জানিয়েছিল। অর্থাৎ পরিস্থিতি অনুযায়ী টিপুর কাজকর্ম আদৌ একমেটে নয়, রঙি-বিরঙি। ইতিহাসবিদ্যার পেশাদারি অঙ্গনে নিছক সওয়াল-জবাবের সীমা ছাড়িয়ে টিপুর মতো ভাল-মন্দ মেশানো এক জটিল ব্যক্তিকে বোঝাটাই বড় কথা।
প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যায়তনে ইতিহাস চর্চার প্রত্যাশা আর জনপরিসরে অতীত চর্চার আকাঙ্ক্ষা প্রায়ই মেলে না। অতীত ও বর্তমানের নানা টানাপড়েনে ইতিহাসবিদ্যার জন্ম। জনপরিসরে অতীতচর্চাটি বর্তমান দিয়েই অতি-নির্ধারিত। বর্তমানের দাবিই অতীতচর্চার অভিমুখটি ঠিক করে দেয়। বর্তমান প্রসঙ্গের জোরালো টানে অতীতের কোনও কথা বা চরিত্র নিছক নিদর্শন হিসেবে হাজির হয়। ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-এর ভাষাকে দাগিয়ে দেওয়ার জন্য ইতিহাসের নজির দেওয়া হয়। তাই জনপরিসরের অতীতচর্চায় আকবর সব সময় পরধর্মমত-সহিষ্ণু ও আওরংজেব চির-অসহিষ্ণু। চৈতন্যদেব সদাসর্বদা সহ্যের পরম অবতার ও ভট্ট কুমারিল মারমুখী দার্শনিক। নিদর্শনের ঐতিহাসিক যাথার্থ্য নিয়ে ততটা ভাবনা নেই, প্রতর্কে অবস্থানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে উদাহরণটা লাগসই হলেই হল। জনপরিসরের বিতর্কে যে যার সিদ্ধান্ত, সব যেন আগে থেকে ঠিক করাই আছে।
এই শঙ্কা থেকেই যে কোনও দেশের জনপরিসরে অতীতচর্চা রাজনীতির অলঙ্কারশাস্ত্রে পরিণত হয়ে যায়। রাজনীতির আধারে পরিস্থিতি মাফিক কখনও তা ভাল, কখনও বা মন্দ। মনে রাখতে হয়, জনপরিসরের লালিত বর্তমানমনস্ক অতীতচর্চার ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া থেকে ইতিহাসবিদ্যাও রেহাই পায় না। ইতিহাসবিদও তো নাগরিক। তাঁর পাঠকরাও তা-ই। অনতিঅতীত কালে চিন-ভারত সম্পর্কের বৃত্তান্ত লেখার সময়ে, বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি বিতর্কের সময়, দলিত গোষ্ঠীর ইতিবৃত্ত রচনাকালে এই ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার ঝাঁঝ ভালমতোই পাওয়া গিয়েছিল। নিগ্রহের নিদর্শনও বিরল নয়। বই নিষিদ্ধ করার তালিকাটিও লম্বা। চৈতন্যদেব, শিবাজি, রামকৃষ্ণ পরমহংস বা শ্রীঅরবিন্দের উপর নথিভিত্তিক ইতিহাসগ্রন্থ নিষিদ্ধ হতে দেখা গিয়েছে। কেননা সম্প্রদায় বা প্রতিষ্ঠান গ্রন্থগুলির বক্তব্যে নারাজ হয়েছিলেন। তসলিমা, রুশদি কিংবা হুসেনের কথা আর তুললাম না। আসল কথা, ভারতীয় জনপরিসরে সহিষ্ণুতার পাশাপাশি অসহিষ্ণুতার স্রোতও সমানেই বয়ে চলেছে। তবু তার মধ্যেই ২০১৫ সালে ভারতীয় জনপরিসরে অতীতচর্চায় এক নতুন গাঁট নজরে পড়ছে।
আজকের প্রতর্কে ঘটছে একটা অতিব্যাপ্তি। নানা সঙ্গ ও অনুষঙ্গে জড়াপট্টি হয়ে অতীতচর্চার পরিসরকে একই সঙ্গে ভয়ঙ্কর ও বিপন্ন করে তুলছে। গো-মাংস বিতর্ক থেকে দৈনন্দিন খাওয়া-পরার অভ্যাস বিচার, টিপুর বার্ষিকী উদযাপন থেকে নাথুরাম গডসের বলিদান দিবস পালন, একটা আর-একটায় প্রসারিত হচ্ছে। উপরন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার জোরে যে-কোনও কথায় তর্কের উত্তাপ শতগুণ বাড়ছে। টিপু বিতর্কে বেঙ্গালুরুর বিমানবন্দরের নামকরণ নিয়ে গিরিশ কারনাডের ব্যক্তিগত অভিমত অতিব্যাপ্ত হয়ে কন্নড় অস্মিতাকে আহত করল। গিরিশ ক্ষমা চাইলেন। মরাঠা শিবাজির ‘মুলক্গিরি’ ও টিপুর আগ্রাসনের তুলনা মরাঠি রাজনৈতিক নেতাদের খেপিয়ে তুলল। জেলা বেলগ্রামের উপর দুই রাজ্যের পরস্পরবিরোধী দাবি প্রতর্কে জড়িয়ে গেল। একটি নিম্নবিত্ত মুসলমান পরিবারের ক্রমউত্থানে গাঁয়ের ঠাকুরদের চোখ টাটাল, গো-মাংস খাবার অজুহাতে অতি নিরীহ গৃহস্থের প্রাণ গেল। এই সব প্রতর্কই আবার ইসলাম ও পাকিস্তানকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ইলেকশনের বুলি বা খানেদের সঙ্গে বাক্-বিনিময়ে ভারতে থাকা বা পাকিস্তানে চলে যাওয়ার নির্দেশ হয়ে উঠছে দেশপ্রেমের আগমার্ক। সবাই বলতে ব্যস্ত, শুনতে নয়। কোন কথার টিকে যে কোন চালে আগুন লাগাবে, কে জানে।
এই অতিব্যাপ্তির সূত্রেই টিপু বিতর্ককে সহনীয় করার উদ্দেশ্যে বলতে পারি যে, জনপরিসরের প্রতর্কে কোন কথা বলা ঠিক আর কোন কথা বলা বেঠিক, তা কী ভাবে ঠিক হবে? সহিষ্ণুতারও তো রকমফের আছে। জনপ্রবাদে ‘প্রাগম্যাটিক’ সহিষ্ণুতার কথা আছে: ‘পড়েছি যবনের হাতে, খানা খেতে হবে তার সাথে।’ গৌড়ীয় বৈষ্ণব সহিষ্ণুতার মন্ত্র হল, ‘মেরেছিস কলসির কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না?’ একেবারে ভক্তপ্রেমিকের প্রাণকথা। এই দুইয়ের মাঝখানে ঠিক কোথায় আছে ভারতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সহিষ্ণুতা, হাজারো সম্প্রদায় ও বিশ্বাসের তন্ত্রে দীর্ণ আধুনিক ভারতীয় সমাজের সহনক্ষমতা? সরকারি বার্তা বা রাজনৈতিক নেতা বা দিদির আপ্তবাণীতে জনপরিসরে সহিষ্ণুতার সমস্যার নিরসন হবে না। দৈনন্দিন জীবনে নিরাপত্তার তাগিদ ও গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রয়োজন বার বার সহিষ্ণুতার চর্চাকে সমস্যাসঙ্কুল করে তুলবে— এ কথা মেনে নেওয়াই ভাল।
গণতন্ত্রে অসহিষ্ণুদেরও স্থান আছে। তাদের জন্যই সহিষ্ণুতা জোরদার হয়। নানা স্তরে অসহিষ্ণুদের বক্তব্য শুনতে হচ্ছে, অসহিষ্ণু কর্মকাণ্ডও দেখতে হচ্ছে ও হবে। ধৈর্য ও মর্যাদা সহকারে সেই সবের রাজনৈতিক মোকাবিলা করা দরকার, তবেই হয়তো আমাদের গণতন্ত্রে কোনও দিন সহিষ্ণুতার রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে। সব ধরনের অসহিষ্ণুতাকে সহিষ্ণুতা একটা কথাই বলতে পারে, ‘ভয় না পেলে ভয় দেখাবে কাকে?’
গণপরিসরে সহিষ্ণুতার প্রাণভোমরা একটি ধারণার মধ্যেই ধরা আছে। সেটা হল, সমাজে অতীতচর্চা বা বর্তমানের প্রতর্ক একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। তথ্য থেকে সত্য বলে বস্তুটা সদা পরিবর্তনশীল। একেবারে শেষ কথা কেউ বলতে পারে না, এমনকী আজকের বা আগামী দিনের ‘জনগণ’ও নয়।