International Mother language Day

আটষট্টি বছর পরেও সেই মহিমা কি আছে? একুশে বলল...

এই একুশের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ায়, তাকে একপাশে টেনে নিয়ে, তার হাত ধরে বসালাম।

Advertisement

পবিত্র সরকার

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০১:০০
Share:

প্রত্যেক বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আসে, আমরা তার দিকে প্রচুর ফুলবেলপাতা ছুড়ে দিই। এমনতুমুল উৎসাহে দিই যে, তার মূর্তি একেবারে ঢেকে যায়। মিছিল করি, স্লোগান দিই, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গাই, রাত জেগে উৎসব করি। শহিদ মিনার প্রতিষ্ঠা করি রাস্তার মোড়ে। বছরে একটা দিন তাকে ধুয়ে মুছে ফুল দিয়ে সাজাই। সবই এখন উৎসব হয়ে যায়, শোকের দিনও তাই।

Advertisement

এই একুশের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ায়, তাকে একপাশে টেনে নিয়ে, তার হাত ধরে বসালাম। বললাম, ‘বোসো, দুটো কথা কই। তুমি ওই সব শহিদের হৃৎপিণ্ড-ছেঁড়া রক্তের চিহ্ন বুকে ধরে আছ সে আজ প্রায় আটষট্টি বছর হল। তুমি তো লক্ষ করেছিলে, ১৯৪৮ থেকে জিন্নার উর্দু ভাষার পক্ষে বক্তৃতার প্রতিবাদ, সে প্রতিবাদ কী ভাবে উত্তাল হতে হতে কী ক্ষমাহীন ক্রোধের জন্ম দিয়েছিল তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে, ক্রোধ থেকে বিদ্রোহে গিয়ে পৌঁছেছিল তা। তার পরে ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩-তে রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্র-সংগীত নিয়ে তুমুল সাংস্কৃতিক সংগ্রাম, তার পরে এল ১৯৬৯, আর সর্বশেষে ১৯৭১। ২১ ফেব্রুয়ারিতে যার শুরু, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর তার শেষ। তার সার্থকতা।’

একুশে বলল, ‘ইতিহাস অত সরল নয়, শুধু সার্থকতার পরে সার্থকতা নয়। কিন্তু তারও পরে সার্থকতার একটা বড় গল্প আছে। ২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়া। আমার আগে আরও ১৯৫১টা একুশে ফেব্রুয়ারি এসেছে আর চলে গেছে, কিন্তু ১৯৫২-র ওই আমি পৃথিবীর সংস্কৃতির ইতিহাসে আলাদা হয়ে গেলাম, আগেকার ১৯৫১টা নিষ্ফলা একুশে ফেব্রুয়ারিও যেন আশ্চর্য মহিমা পেল।আমার পরে এসে চলে যাওয়া ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলোতেও এ রকম আর কিছু ঘটবে কি না সন্দেহ, কিন্তু মানুষের সভ্যতার অনাগত হাজার হাজার বছরের সব ক-টা ২১ ফেব্রুয়ারির মানেই আমার জন্য কেমন বদলে গেল। কোনও সালের রইল না, কোনও দেশের না। পৃথিবীর সবগুলো দেশের ২১ ফেব্রুয়ারিও আমারই সঙ্গেএক হয়ে গেল। বলতে লাগল, ‘‘নিজের ভাষার জয় হোক।”

Advertisement

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আজ, এই আটষট্টি বছর পরে, সেই মহিমা কতটা ধরে রেখেছ তুমি?’

একুশে বলল, ‘কী ধরে রাখব? যে মাতৃভাষার জন্য এত কাণ্ড, সেই মাতৃভাষা নিয়ে কী করছ তোমরা? পৃথিবীর সবাই যখন মাতৃভাষা প্রাণপণে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই শুরু করেছে, সেখানে তোমরা তাকে নিয়ে কী খেলায় মেতেছ আমাকে বলবে? তোমাদের বাপ-মায়েরা বলছে ও সব বাংলা-ফাংলা পড়তে হবে না, দুটো ন আর তিনটে শ নিয়ে, যুক্তাক্ষর নিয়ে কত কী বিচ্ছিরি প্যাঁচ করে রেখেছে এই ভাষা, আমার সোনার চাঁদ ছেলেমেয়েরা বলে, “উঃ, কী কঠিন ভাষা! এ শিখে কী হবে? বাংলা দিয়ে কি ধুয়ে খাব?” আর সে কথা শুনে বাপ-মায়েরা বলে, ‘আহা রে, যে ভাষা শিখতে আমার সোনার চাঁদের এত কষ্ট হয় সে ছাতার ভাষা শিখে কী হবে?’ আর তোমাদের বাংলার কী ছিরি গো ! “আমি অ্যাকচুয়ালি এ কথাটা মিন করিনি ভাই। বাট, টু টেল ইউ ফ্র্যাঙ্কলি, ওর কথাটা আমি লাইক করিনি। ও রেস্পেক্টেড লোককে রেস্পেক্ট দিতে জানে না, কার্টসি কাকে বলে জানে না, ওর এই বিহেভিয়ারে সবাই ইনসাল্টেড ফিল করে।ভদ্রলোকের সোসাইটিতে ওকে ছেড়ে রাখা ডেঞ্জারাস?”এটাকে বাংলা বল তোমরা? এ বাংরিজিই নাকি পশ্চিমবঙ্গে এখন তোমাদের জাতীয় ভাষা!’

‘তা ইংরিজি শিখতে গেলে ও রকম একটু-আধটু হবে না?’

‘এটা ইংরিজি শেখার নমুনা নাকি? আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এ রকম বাংলা যারা বলে, তাদের বেশিরভাগইএকটা ইংরেজি বাক্যও শুদ্ধভাবে বলতে পারে না। তারা ইংরিজিও শেখেনি, বাংলাও ভুলতে চলেছে।’

‘তা কী করবে আমাদের ছেলেমেয়েরা? চাকরি মেলে ইংরিজি শিখলে। সেটা শিখব না?’

‘ও মা, সে কথা আমি কখন বললুম? ইংরিজি একশোবার শিখবে। ইংরিজি শিখবে, ফরাসি জার্মান স্প্যানিশ শিখবে, সংস্কৃত আরবি ফারসি শিখবে। তাই বলে সব ইংলিশ মিডিয়ামে ঠেলে ছেলেমেয়েদের নিজের জন্ম ভাষাটাকে ভুলিয়ে দেবে কেন? ঠিক আছে, যে ভাষায় দু’-বাংলাতেই রোজ একটা করে দৈনিক কাগজ বেরোচ্ছে, নতুন টিভি চ্যানেল হচ্ছে, হাজার হাজার কবি লেখক হাজার হাজার বই নিক্ষেপ করছেন প্রতি বইমেলায়, লিট্‌ল ম্যাগাজিনে ছয়লাপ হয়ে যাচ্ছে দেশ, এমনকি, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, টরন্টোতে পর্যন্ত চলছে বাংলা কাগজ, বাংলা টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেটে ফেসবুকে ইউটিউবে পর্যন্ত বাংলা জায়গা দখল করছে—সে ভাষাকে মেরে ফেলা অত সহজ নয়। কিছু ছেলেমেয়ে ভাষাকে ছেড়ে যাবে তো আরও লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে ভাষার কাছে আসবে। ‘ওমা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো’ বলে।’ একটু থেমে একুশে বলল, ‘আমি কি একটু বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি?’ তার গলাটা ধরা-ধরা মনে হল যেন।

আমি হেসে তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বললাম, ‘তা হয়তো পড়ছ, সে ঠিক আছে। বল, কী বলছিলে?’

‘আর এই মুখের বাণী? জীবনে কি ভেবেছিলাম কোনও দেশের রাজনৈতিক মহিলারা, প্রকাশ্য বক্তৃতায় মধ্যে ‘শালা’ বলবেন, বলবেন ‘বাম্বু দেওয়া’র মতো অশ্রাব্য বদকথা? বিধানসভায় মহিলাই আর এক মহিলাকে উ‏‏দ্দেশকরে বলবেন কুৎসিত ভাষা!রাজনৈতিক নেতা মুখে গালাগালের ফোয়ারা ছোটাবেন প্রকাশ্য জনসভায়? তাতে হাততালি পড়বে? এই জন্যই কি শহিদেরা প্রাণ দিয়েছিল?’

আমি একুশেকে বললাম, ‘দ্যাখো, এখন দিনকাল অনেক বদলে গেছে, মানুষের ভাষাও বদলে গেছে। একজন পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে যাওয়া কবি বলেছেন, এ সব শব্দ হল হিরের টুকরো।’

‘হ্যাঁ, হিরের টুকরোই বটে। এই ক’বছর আগে বাংলাদেশে এক সাংসদের ‘চুদুরবুদুর’ কথাটা নিয়ে দু-বাংলায় কী হইচই পড়ে গেল। তাও সেটা ছিল গ্রাম্যভাষা, সে অর্থে অশালীন নয়। এই রকম রকের ভাষা বা কলেজের ছেলেমেয়েদের বুলিও আমি অশ্লীল মনে করি না। কিন্তু এখন তো অশালীন ভাষা ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে মুড়ি-মুড়কির মতো, তোমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের মুখে কিছুই আটকাচ্ছে না। পশ্চিমবাংলা শুনেছি এ ব্যাপারে অনেকটা এগিয়ে গেছে!’

আমি হাতজোড় করে বললাম, ‘দোহাই, বাংলাদেশ যেন একটু পিছিয়েই থাকে এই জায়গায়, আমরা অত প্রগতি চাই না আমার বাংলাদেশি ভাইবোনদের জন্য।’

একুশে আবার একটু থেমে বলল, ‘আমি বড়ঘন ঘন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি আজকাল।’

আমি বললাম, ‘এই আবেগ অক্ষয় হোক। ওই আবেগটুকু ছিল বলেই বাঙালি বেঁচে আছে।’

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement