আপনার অভিমত

গণনাট্য সঙ্ঘ রাজনৈতিক মতাদর্শের মুখপাত্র ছিল না

বিজন ভট্টাচার্যের ‘জবানবন্দী’র পর যখন ‘নবান্ন’ নাটকটি প্রকাশ পেল, তখনই ‘নবান্ন’ নাটকেই সাধারণ মানুষের কাছে গণনাট্য ব্যাপারটি স্পষ্ট হল। লিখলেন রাহুল হালদার বিজন ভট্টাচার্যের ‘জবানবন্দী’র পর যখন ‘নবান্ন’ নাটকটি প্রকাশ পেল, তখনই ‘নবান্ন’ নাটকেই সাধারণ মানুষের কাছে গণনাট্য ব্যাপারটি স্পষ্ট হল। লিখলেন রাহুল হালদার

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৩২
Share:

সারা দেশব্যাপী ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের পঁচাত্তর বছর পূর্তি নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে পালিত হচ্ছে। আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে, ২৫ মে ১৯৪৩ সালে গণনাট্য সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সঙ্ঘ তৈরি হওয়ার মূলে যে কারণ ছিল, সেটা হল দুই বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে সাধারণ মানুষদের পুঁজিপতি ও মুনাফা লোভীদের দ্বারা অত্যচার এবং সারা বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জোর প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তাই বলে হঠাৎ করে গণনাট্য সঙ্ঘ গড়ে ওঠেনি, এই সঙ্ঘের সূতিকাগার ছিল তৎকালীন সারা বিশ্ব জুড়ে বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা গড়ে ওঠা World Congress of Writers for Defence of Culture।

Advertisement

বিংশ শতকের তিরিশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সারা বিশ্বের মানুষ ফ্যাসিবাদের ভয়ঙ্কর ফলশ্রুতি সম্পর্কে সচেতন হয়। তার লক্ষণ দেখতে পাওয়া গিয়েছিল তিরিশের দশকের গোড়ায়, ১৯৩১ সালে জাপানের প্রথম মাঞ্চুরিয়া আক্রমণের মধ্যে দিয়ে। এর পর হিটলার জার্মান গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে এক গণভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে তাঁর নাৎসি বাহিনী দিয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু করেন। ১৯৩৫ সালে ফ্যাসিস্ট ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণ ইত্যাদি সমস্ত কিছু ঘটনা লক্ষ করে সারা বিশ্বের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী মানুষেরা একজোট হন। ১৯৩৫ সালে ২১ জুন ফ্রান্সের প্যারিস শহরে প্রায় চল্লিশটি দেশের আনুমানিক দু’শো চল্লিশ জন প্রতিনিধির আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। সেই সম্মেলনে স্থির হয়, শিল্পীরা তাঁদের শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের বিপদ তুলে ধরবেন, বিরোধিতা করবেন। বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবিরোধী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিবাদ মঞ্চ গড়ে উঠতে দেখে ভারতের প্রগতিশীল শিল্পী-সাহিত্যিকেরাও এই আন্দোলন থেকে মুক্ত হতে পারলেন না।

রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণের মধ্যেও সাম্যবাদী ভাবনায় সমাজতান্ত্রিক চিন্তার উন্মেষ ঘটেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের নগ্ন রূপ দেখে বীতশ্রদ্ধ নাগরিকদের মধ্যে সাম্যবাদী চিন্তার সংগঠন আস্তে আস্তে পরিপুষ্ট হতে থাকে। ১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে গড়ে ওঠে League against Fascism and War; নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেসের সভাপতির পদে অনুমোদন পেলে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া উপলক্ষে কলকাতায় সারা ভারত প্রগতিশীল লেখকবৃন্দ প্রথম ছাত্রদের সামনে তুলে ধরেন ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রামের গুরুত্ব। সেই অনুষ্ঠানের পরেই যুব সংস্কৃতি মঞ্চ থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসি-বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে।

Advertisement

এর পরে বাংলার শিল্পী সাহিত্যিক গোষ্ঠীও কল্পনা-বিলাসকে দূরে সরিয়ে রেখে বাস্তবতাকে সাহিত্যের মধ্যে নিয়ে এলেন। ধীরে ধীরে বহু শিল্পী-সাহিত্যিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্ব তথা ভারতের মানবগোষ্ঠীর হতাশা, দুর্দশা, বাস্তুচ্যুত মানুষের জীবনকাহিনি নিয়ে সাহিত্য রচনা করতে লাগলেন। এঁরাই সমবেত ভাবে তৈরি করলেন একটি নতুন সংস্থা। সেই সংস্থার নাম দিলেন ‘ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ’। ১৯৪১ সালে সত্যেন মজুমদারের সম্পাদিত ‘অরণি’ নামে একটি ফ্যাসিবিরোধী পত্রিকা বার হল ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের মুখপত্র হিসেবে। এই সঙ্ঘের শিল্পীদের শিল্পসৃষ্টির মূল প্রেরণা এল গণজীবন থেকে। সংস্থার কাজকর্মে উৎসাহিত হয়ে শিবিরে এসে যোগ দেন মনোরজ্ঞন ভট্টাচার্য ও কবি হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। মনোরঞ্জন মঞ্চ অভিনয়ের সহযোগিতার মাধ্যমে এবং হরীন্দ্রনাথ একটি গানের দল তৈরি করে সংস্থাকে আরও উৎকর্ষের দিকে এগিয়ে দিলেন।

এই সময়ে দেশে বিয়াল্লিশের আন্দোলন, বন্যা, যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক মন্দা, ব্রিটিশ শোষণের মাত্রা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে যে মন্বন্তর দেখা দিল, সেই অস্থির সময়ে রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন লোকজনেরা ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং বাংলায় গণনাট্য আন্দোলন দানা বাঁধল।

এই রকম পরিস্থিতিতে এক দিকে মুনাফাদারদের শোষণ, অন্য দিকে শোষিত সাধারণ মানুষের খাদ্যের জন্য হাহাকার— সব মিলিয়ে সমাজজীবন প্রচণ্ড ভাবে নাড়া খেল। কৃষক, শ্রমিক, বেকার যুবক ও সমাজের নিম্নস্তরীয় সকল মানুষই সুষ্ঠু জীবনের অধিকারী, এই দাবি জোরালো ভাবে তুলে ধরার জন্য প্রগতিশীল লেখক-শিল্পীদের নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক সংস্থা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ। এই সঙ্ঘে যুক্ত হলেন পৃথ্বীরাজ কপূর, বলরাজ সাহনি, বিজন ভট্টাচার্য, উৎপল দত্ত, সলিল চৌধুরী, রবিশঙ্কর, ঋত্বিককুমার ঘটক প্রমুখ। গণনাট্য সঙ্ঘের চিন্তায় বিষয় হল জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, সর্বোপরি সংগ্রাম। বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’, ‘জবানবন্দী’র পরে যখন ‘নবান্ন’ নাটক প্রকাশ পেল, সাধারণ মানুষের কাছে গণনাট্য ব্যাপারটি ধীরে-ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল।

তাই গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম দিকে কোনও একটি রাজনৈতিক পার্টির সংস্থা হলেও এটি কখনওই কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শের মুখপাত্র ছিল না। এটি ছিল কৃষক ও জমিদার-জোতদারদের, শ্রমিক-মালিক, শোষণজীবী ও অত্যাচারী শক্তির সঙ্গে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংগ্রামের মঞ্চ, জনগণের মঙ্গলসাধন ও মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার কেন্দ্র। যেটিকে বিজন ভট্টাচার্য নিজের জবানিতেই বলেছিলেন— ‘‘বিয়াল্লিশের আন্দোলন ও তেতাল্লিশের মন্বন্তর আমায় নাড়া দিয়েছিল। দেখতাম বাচ্চা ছেলে টেলিগ্রাফের তার কাটতে গিয়ে গুলি খেয়ে টুপ করে পড়ে মরত। আমি নিজেও একদিন প্রচণ্ড মার খেলাম, তার পর দুর্ভিক্ষ এল। ক্ষুধিতদের ট্র্যাজেডির উৎস ও গভীরতার প্রকাশ ক্ষমতা আমার ছিল না। শেষ পর্যন্ত ভাবলাম, ওরাই যদি ওদের কথা বলতে শুরু করে, ওরা নিজেরাই সামনে এসে দাঁড়াক। ওরা কেমন করে কথা বলে, কেমন করে হাসে, কেমন করে জানে, বোধ করে, আমার জানা ছিল। তাই নিয়ে যদি কিছু করি তা হলে কিছু করা যেতে পারে। সেই চেষ্টাতেই প্রথমে আগুন, তারপর জবানবন্দী এবং জবানবন্দী সাকসেস হওয়াতেই লিখলাম নবান্ন। ন’দিনে নবান্ন লিখলাম, প্রগতি লেখক সঙ্ঘে পড়া হল ‘নবান্ন’। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন ‘আপনি তো জাত চাষা’। আমি তখন কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য। অগস্ট আন্দোলনকে স্বাগত জানানো নিয়ে গোলমাল বাধল। এর অল্প পরে আমি আনন্দবাজারের কাজ ছেড়ে পার্টি হোলটাইমার হই। আট থেকে নয় ঘণ্টা রোজ রিহার্সাল হত ‘নবান্ন’ হ্যারিসন রোড পার্টি কমিউনে, পিপলস ক্লিনিকে, পার্টি অফিসে, ৪৬ ধর্মতলা স্ট্রিটে। প্রথম সাতটি অভিনয় হয় শ্রীরঙ্গমে।.... আমরা নানা জায়গায় ‘নবান্ন’ নিয়ে যাই। আমাদের নীতি ছিল, আমরা পার্টির কথা বলব না। দেশের দশের কথা বলব। আমাদের কাজ জমি তৈরি করা, তোমরা বীজ বুনবে। আমরা মানুষকে তৈরি করতে চেয়েছিলাম ‘হিউম্যানিস্ট’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।’’

সঙ্গের ছবিটি নবান্ন নাটকের।

শান্তিপুর হরিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement