প্রতীকী ছবি
দলিত সাহিত্যের জন্য কি আদৌ পৃথক আকাদেমি গঠনের প্রয়োজন ছিল? গত কয়েক সপ্তাহ এই প্রশ্নটি লইয়াই আলোড়িত হইল পশ্চিমবঙ্গের সমাজ। উত্তর: অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। তফসিলি জাতি বা অপরাপর পশ্চাদ্বর্তী শ্রেণিভুক্ত লেখকদের সঙ্কলিত কাজ প্রকাশ করিবার জন্য পশ্চিমবঙ্গ দলিত সাহিত্য আকাদেমি প্রতিষ্ঠা, দলিত সাহিত্য সংগ্রহে রাজ্যে বিশেষ গ্রন্থাগার নির্মাণ— সিদ্ধান্তগুলি স্বাগত। দ্বিতীয়ত, উপস্থিত রাজবংশী ভাষা আকাদেমির সম্প্রসারণের কথা জানানো হইয়াছে। ইহার সহিত সাঁওতাল এবং কুরুখের ন্যায় কিছু জনজাতির ভাষাও সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করিবে। পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রসারিত হইবে হিন্দি আকাদেমিও। বহুভাষিক ঐতিহ্য পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের আত্মাস্বরূপ। সেই সমৃদ্ধির প্রচার এবং তাহাতে উৎসাহ দান অতি জরুরি কর্তব্য। তৃতীয়ত, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর বিষ্ণুপুর সংগ্রহশালা এবং আচার্য যোগেশ চন্দ্র পুরাকীর্তি ভবন কর্তৃক সংরক্ষিত তিন হাজার অপ্রকাশিত সংস্কৃত পুঁথি ‘ডিজিটাইজ়েশন’-এর ব্যবস্থা হইবে।
অস্বীকার করা যায় না, এই বঙ্গে দলিত সাহিত্যের ঐশ্বর্যবান ইতিহাস থাকিলেও এত কাল তাহা অলক্ষ্যেই পড়িয়াছিল। মনোহর মৌলি বিশ্বাসের ছোটগল্প ও উপন্যাস বহু ভাষায় অনূদিত, দেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য; মনোরঞ্জন ব্যাপারীর ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন গ্রন্থটিও সমগ্র দেশেই জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছে। অথচ তাঁহারা স্ব-রাজ্যে ততখানি স্বীকৃতি বা পরিচিতি পান নাই। সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের ন্যায় দলিত নেতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হইলেও আজ তিনি বিস্মৃতপ্রায়। সেই অতীতকে স্মরণ করাইয়া দিতেই সরকারের এই উদ্যোগ। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে সংস্কৃত পুঁথি সংরক্ষণ এবং তাহার প্রতিলিপি সরকারের ডিজিটাল গ্রন্থাগারে তুলিয়া দিবার ভাবনাটিও তদনুগ। ষোড়শ, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে সংস্কৃত ও বৈষ্ণব সাহিত্যের পীঠস্থান ছিল এই শহর। অপর দিকে, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার, বিশেষত কোচবিহারের জনসংখ্যার পঞ্চাশ শতাংশেরও অধিক রাজবংশী। বিবিধ সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দিবার আর একটি উদাহরণ তাহাদের আকাদেমির উন্নয়ন।
ভাষা ও সাহিত্য যে আমূল রাজনৈতিক বিষয়, তাহা আজ প্রশ্নাতীত। কেন্দ্রীয় সরকার ছলে বলে কৌশলে হিন্দি চাপাইয়া দিতে চাহে— তাহা এক ধরনের রাজনীতি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাহিত্য এবং প্রান্তিক ভাষাগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়া, মূলধারায় তাহাদের জন্য সম্মানের আসন বরাদ্দ করা আর এক ধরনের রাজনীতি। দ্বিতীয় পথটি ভারতের আত্মাকে স্পর্শ করিয়া যায়, তাহাতে বহুত্ববাদের স্বীকৃতি আছে। দলিত সাহিত্য বর্ণাশ্রমের বিরুদ্ধে, মনুবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অস্ত্র— তাহাকে মান্যতা দেওয়া উগ্র হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনের প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক অবস্থানই বটে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্তকে এই বৃহত্তর পরিসরে দেখা বিধেয়। সর্বজনীনতার মধ্যে গ্রহণ আছে, বর্জন নাই— হিন্দি আগ্রাসনের প্রতিস্পর্ধী অবস্থানে কিন্তু হিন্দি ভাষাকে ব্রাত্য করা হয় নাই, তাহাকে অন্য ভাষাগুলির ন্যায় গুরুত্ব দেওয়া হইয়াছে। ইহাই ভারতের ভাষানীতির মৌলিক অবস্থান, যেখানে কোনও একটি ভাষা অন্য কোনও ভাষার প্রতিদ্বন্দ্বী নহে। সহাবস্থানই ভারতের ধর্ম, বিভেদ নহে।