অতিরিক্ত বিমানির্ভরতা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল নহে। স্বাস্থ্যনীতির বিশেষজ্ঞরা এই আপত্তি পূর্বেই জানাইয়াছিলেন। এখন জানাইলেন চিকিৎসকেরা। ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন সম্প্রতি ‘আয়ুষ্মান ভারত’-এর অন্তর্গত বিমা প্রকল্পটি (প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা) পুনর্বিবেচনা করিবার পরামর্শ দিয়াছে কেন্দ্রকে। বিমা প্রকল্পের দ্বারা সকল নাগরিকের স্বাস্থ্যের অধিকারের সুরক্ষা সম্ভব কি না, এ প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠিয়াছে। এখন চিকিৎসকেরা অভিযোগ করিলেন, বিমার শর্ত মানিতে না পারিয়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি হাসপাতালগুলি বন্ধ হইয়া যাইতেছে। লাভবান হইতেছে বৃহৎ কর্পোরেট হাসপাতাল। তাহাতে চিকিৎসার খরচ বাড়িবে। বিপন্ন হইবে বিমা-বহির্ভূত স্বল্পবিত্ত ও মধ্যবিত্তেরা। অতএব বিমাসংস্থার মধ্যস্থতার প্রয়োজন নাই, চিকিৎসায় সরাসরি রাজস্ব ব্যয় করুক সরকার। সেই অর্থ সরকারি হাসপাতালে বিনিয়োগ হউক। বেসরকারি হাসপাতাল দরিদ্রের চিকিৎসা করিলে ওই অর্থে তাহা পূরণ হইবে। ২০১০ সালে ইউপিএ সরকার নিযুক্ত উচ্চস্তরীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি এমনই সুপারিশ করিয়াছিল। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনার বিরুদ্ধে সওয়াল করিয়া কমিটি বলিয়াছিল, বিমা বড় হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ মিটায় ঠিকই, কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসা ও বহির্বিভাগের চিকিৎসার খরচ দেয় না। অথচ এই সকল চিকিৎসার ব্যয়ও নাগরিককে বিপন্ন করে। তাই বিমার জন্য ব্যয় না করিয়া আবশ্যক চিকিৎসার একটি ‘প্যাকেজ’ তৈরি প্রয়োজন। তাহার অন্তর্গত চিকিৎসাগুলি বিনা খরচে মিলিবে, অধিকাংশ মিলিবে সরকারি হাসপাতালে। যেগুলি মিলিবে না, সরকার তাহা ক্রয় করিবে চুক্তিবদ্ধ বেসরকারি হাসপাতাল হইতে।
চিকিৎসার অধিকারকে বিমা-নির্ভর করা উচিত কি না, সে আলোচনা প্রয়োজন। কারণ দরিদ্রের চিকিৎসাকে বিমা-নির্ভর করিবার ঝুঁকি ইতিমধ্যেই প্রকট হইয়াছে। অস্ত্রোপচারের টাকা জোগাড় করিতে পারেন নাই ত্রিপুরার এক দিনমজুর। তাঁহাকে গুরুতর আহত দেখিয়াও সরকারি মেডিক্যাল কলেজ অস্ত্রোপচার করিতে রাজি হয় নাই। কারণ ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পের অধীন হইতে তিনি পারেন নাই। যে দিন বিমার কার্ডকে বিনামূল্যে সরকারি চিকিৎসার শর্ত করিয়াছে ত্রিপুরা সরকার, তাহার পর দিনই ওই শ্রমিকের মৃত্যু হইয়াছে। অথচ সার্বিক বিমার ব্যয়ভার বিপুল। এই কারণে ব্রাজিল, তাইল্যান্ডের মতো উন্নয়নশীল দেশ সরকারি চিকিৎসাকে উন্নত করিতে অধিক বরাদ্দ করিয়াছে। ভারতের জন্যও কি ইহাই যথার্থ পথ নহে? বিনামূল্যে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসার আকর্ষণ যথেষ্ট, কিন্তু কিছু রাজ্যে সরকারি বিমার অধীনে চিকিৎসাপ্রাপ্ত রোগীদের সত্তর শতাংশই চিকিৎসা করাইয়াছেন বেসরকারি হাসপাতালে। এই বিপুল টাকায় সর্বস্তরের সরকারি হাসপাতাল উন্নত হইলে কি জনস্বার্থ অধিক সুরক্ষিত হইত না? ভারতে সরকার জাতীয় মোট উৎপাদনের মাত্র এক শতাংশ খরচ করে স্বাস্থ্যের জন্য, যেখানে চিন করে সাড়ে পাঁচ শতাংশ। বরাদ্দ এত অল্প বলিয়া বিমার পরিসর বৃদ্ধি হয় নাই। একটি হিসেব, স্বাস্থ্যের জন্য বর্তমানে যাহা বরাদ্দ, তাহাতে মাত্র তিরিশ শতাংশ দরিদ্র পরিবার বিমার সুবিধা পাইতে পারে। অতএব বিমার উপর নির্ভরতা কমাইয়া সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা নিশ্চিত ও উন্নত করিবার উপায় ভাবিতে হইবে।