পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তন নিয়ে না ভাবলে

যুক্তির গ্রহণ লাগলে বিপদ

সূর্যগ্রহণ সেই সব প্রাকৃতিক ঘটনার একটা, যেগুলোর জ্যোতির্বিদ্যাগত চক্র আছে, মানে, যেগুলো অনেক দিন পর পর ঘটে, যেগুলোর হিসেব করা হয় বছরের গুণিতকে।

Advertisement

নাইজেল হিউজ

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share:

আমেরিকায় কিছু দিন আগে কয়েক হাজার মানুষ অসামান্য একটি পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখলেন, যেমন ভারতে ২০০৯ সালে অনেকে দেখেছিলেন। পূর্ণগ্রাস একটা রুদ্ধশ্বাস ঘটনা: দিনের মাঝামাঝি একটু একটু করে অন্ধকার হয়ে আসছে, তার পর আবার আস্তে আস্তে সূর্য তার গোটা ঔজ্জ্বল্যই ফিরে পাচ্ছে। আমাদের পূর্বসূরিরা এ সব দেখে স্বাভাবিক ভাবেই খুব ঘাবড়ে যেতেন, কারণ তাঁদের কাছে এগুলো ছিল বিরল ও অপ্রত্যাশিত ব্যাপার। এখন সেই তুলনায় কম মানুষ গ্রহণকে ভয় পান। কারণ এখন এর হালহদিশ জানা, আর আগে থেকেই বলে দেওয়া যায় কবে গ্রহণ হবে। এখন আমরা জানি, গ্রহণে ভয়ের কিছু নেই।

Advertisement

সূর্যগ্রহণ সেই সব প্রাকৃতিক ঘটনার একটা, যেগুলোর জ্যোতির্বিদ্যাগত চক্র আছে, মানে, যেগুলো অনেক দিন পর পর ঘটে, যেগুলোর হিসেব করা হয় বছরের গুণিতকে। কয়েকটা তো ঘটে হাজার বছর পর পর, বা তারও বেশি ব্যবধানে। সৌরজগতের জটিল গণিত জানা থাকলে, তার পূর্বাভাস দেওয়া যায়। এদের মধ্যে কয়েকটার প্রভাব পৃথিবীর আবহাওয়ার ওপর পড়ে। পদার্থবিজ্ঞান জানায়, কোন প্রক্রিয়ার ফলে কোথায় কখন এ ধরনের কিছু ঘটবে। আর ভূবিদ্যা জানায় এই ধরনের ঘটনার ইতিহাস, মানে, অতীতে এই ব্যাপারগুলোর ফলে পৃথিবীতে কী কী হয়েছে, যাতে আমরা সেগুলো থেকে একটা ধাঁচ বুঝতে পারি।

২০০৯ আর ২০১৭-র পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের উৎসুক দর্শকদের মধ্যে সব ধরনের মানুষ ছিলেন, যাঁদের ঐতিহ্য বা শিক্ষাদীক্ষা আলাদা আলাদা রকম, এমনকী পৃথিবী কী ভাবে সৃষ্টি হল— সে বিষয়ে বিশ্বাসও আলাদা। পৃথিবীর ইতিহাস সম্পর্কে মূল ধর্মগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি ভীষণ রকম অন্য। আব্রাহামীয় শাস্ত্রের আক্ষরিক ব্যাখ্যা করলে, অনেকেই ভাববেন যে পৃথিবী মোটে ছ’হাজার বছরের পুরনো। ভারতীয় পুরাণ অনুযায়ী আবার, এই বয়স সাংঘাতিক বেশি, প্রায় ৩১২,০০০,০০ কোটি বছর (৩৬,০০০ কল্প)। বিজ্ঞান অন্য রকম ভাবে ব্যাপারটার সমাধানের চেষ্টা করে। কোনও শাস্ত্র বা প্রচলিত বিশ্বাসের বদলে, সে সরাসরি পৃথিবীকেই প্রশ্নটা করে, তার বয়স কত। অনেক ভাবে এটা করা হয়, কিন্তু উত্তরটা মোটামুটি একই পাওয়া যায়। আমাদের পৃথিবী মোটামুটি ৪৬০ কোটি বছর পুরনো আর এই লম্বা সময়ে সে অসংখ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে।

Advertisement

যেখানে অধিকাংশ মানুষ বাঁচেন খুব বেশি হলে নব্বই বছর, আমরা পৃথিবীর প্রকৃত বয়স আর গভীর ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামাব কেন? কারণ, সূর্যগ্রহণেরই মতো, একটা ব্যাপারকে ঠিক করে বোঝাই হল সেটার রহস্য ভেদ করার উপায়। একটা অতীত ঘটনার মানে আমাদের কাছে এখন কী, আর ভবিষ্যতে কী হবে, সবটাই এই বোঝার উপর নির্ভর করে। আমরা পৃথিবীর ইতিহাসের এক আশ্চর্য মুহূর্তে বাঁচছি। হয়তো ৪৬০ কোটি বছরের মধ্যে এই প্রথম, গোটা গ্রহের পরিবেশকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করছে একটি নির্দিষ্ট জীবিত প্রজাতির কাজকর্ম, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে। সেই প্রজাতিটি, অবশ্যই, হোমো সেপিয়েন্‌স, যা বিবর্তিত হয়েছে মাত্র দু’লক্ষ বছর আগে।

এই পৃথিবীতে আমাদের অবস্থানটা কোথায়, সে সম্পর্কে আমাদের ধারণাটাই ঠিক করবে, আমরা অনেকগুলো সম্ভাবনার মধ্যে কোনগুলোকে বেছে নেব। আমরা যদি পৃথিবীকে ভাবি সম্প্রতি সৃষ্টি হওয়া একটি গ্রহ, যা মূলত মানুষের কর্মকাণ্ডের মঞ্চমাত্র, তা হলে পরিবেশের সঙ্গে যে নীতিগত প্রশ্নগুলি জড়িয়ে আছে, সে বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি অন্য রকম হবে। আর আমরা যদি ভাবি পৃথিবী এক বহু প্রাচীন ও প্রণম্য গ্রহ, যেখানে মানুষ এসেছে এই সে দিন, বা পৃথিবী লক্ষ লক্ষ বছর ধরে একটা পরিবেশ তৈরি করেছে মানুষের আবির্ভাবের একটা ক্ষণস্থায়ী সুযোগ দেওয়ার জন্যে, তখন নীতি আলাদা হবে। আবার কেউ যদি ভাবে, পৃথিবী নিশ্চিত ভাবেই চিরায়ুসম্পন্ন, অনন্ত কাল থাকবে, আর মানুষ সেখানে এমন কিছুই বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারবে না, তার নৈতিক নির্বাচন আলাদা হবে। তাই, আমাদের প্রজাতির ইতিহাসে এই প্রথম, আমরা পৃথিবীর বয়স ও ইতিহাস সম্পর্কে কী ভাবি, তার উপর অনেকটা নির্ভর করছে আমাদের নীতিগুলোর অবস্থান। সেই জন্যই মানুষের কাজকর্মের ফলে আবহাওয়ার যে পরিবর্তন ঘটেছে— যা বিজ্ঞান একদম পরিষ্কার ভাবে দেখিয়ে দেয়— সে বিষয়ে প্রশ্ন এখন এত জরুরি আর নৈতিক ভাবেও গুরুত্বপূর্ণ।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিটা মেনে নিলে তা থেকে কোন নৈতিক সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া যায়? ধরা যাক এই প্রশ্নটা: আমাদের কি অধিকার আছে একটা গ্রহকে বিকৃত করার, যেখানে আমরা নবাগত? বিজ্ঞানের কোনও অন্তর্লীন নৈতিকতা নেই, এ নিয়ে সে সরাসরি কিছু বলে না, কিন্তু অতীত ঘটনা স্পষ্ট বার্তা দেয়। কারণ তারা আমাদের কাজগুলোর সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে আমাদের জানিয়ে দেয়।

কয়েকটা বার্তা এই রকম:

ক) পৃথিবীর আবহাওয়া আগেও বহু বার অতি দ্রুত পালটে গেছে। সে জন্য মানুষ দায়ী ছিল না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এখন আবহাওয়া বদলের সময় সেগুলো নিয়ে ভাবার দরকার নেই।

খ) ভূতত্ত্বের অনেক কিছুই মাপা হয় লক্ষ বছরের এককে। কিন্তু কয়েকটা নাটকীয় আবহাওয়া পরিবর্তন ঘটেছিল কয়েক বছরেই। সে রকম কিছু যদি আবার ঘটে, তা হলে মানুষের ক্ষেত্রে তার ফল হবে সাংঘাতিক, চূড়ান্ত ও তাৎক্ষণিক বিপর্যয়কর।

গ) শেষ ৫৪০ মিলিয়ন বছরে পাঁচ বার ‘বিপুল বিনাশ’-এ জীবিত প্রজাতির ৭৫% বা তার বেশি বিলুপ্ত হয়েছে। ভূতাত্ত্বিক সময়ের নিরিখে সময়টা বেশ কম হলেও মানুষের ইতিহাসের বিচারে নয়।

ঘ) এই প্রত্যেকটি ‘বিপুল বিনাশ’-এর ক্ষেত্রেই আবহাওয়ার দ্রুত বদল ঘটেছে এবং তা এই বিনাশের একটা বড় কারণ। পৃথিবীতে উল্কা এসে পড়ার ফলে যখন ডাইনোসররা বিলুপ্ত হয়েছে, সে ক্ষেত্রেও আবহাওয়ার ভূমিকা আছে। উল্কা এসে পড়ার ফলে আবহাওয়ার যে পরিবর্তন হয়েছে তার জন্যেই ডাইনোসর ও অন্য প্রাণীরা লুপ্ত হয়েছে।

ঙ) যত বড় মাপে এই ‘প্রলয়’ ঘটেছে, ততই আগের চেয়ে একদম অন্য ধরনের গাছ ও প্রাণীরা জন্মে পৃথিবীর দখল নিয়েছে।

এই তথ্যগুলো থেকে তা হলে আমরা কোন নৈতিক সিদ্ধান্ত নেব? প্রথমত, যদি আমরা বিজ্ঞানকে প্রত্যাখ্যান করি, অতীতের ব্যাপার জানার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে একটা উপায় হিসেবে অস্বীকার করি, তা হলে এই সতর্কীকরণগুলোকে উপেক্ষা করা নৈতিক ভাবে ঠিক কাজ বলে মনে হতে পারে। আমেরিকার অনেকেই এই মনোভাবাপন্ন, তাঁরা সরকারি স্কুলে পৃথিবীর ইতিহাস পড়াবার বিরোধিতা করে থাকেন। কিন্তু বিজ্ঞানের অবদানগুলোকে আমরা ভোগ করব, তার পর বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তগুলোকে প্রত্যাখ্যান করব— এটাও কি নৈতিক ভাবে ঠিক? এই মুহূর্তে খুব কম জীবিত মানুষই আছেন, যিনি মানুষের অন্যতম আশ্চর্য চেষ্টা— পৃথিবীকে অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপার না মনে করে প্রাকৃতিক ভাবে বোঝার চেষ্টা— থেকে কোনও সুবিধে পাননি। এই চেষ্টাটাকেই আমরা বলি বিজ্ঞান। আমাদের মধ্যে কে আছেন, যিনি কখনও অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ খাননি? বা, কোনও দিন বাসে চড়েননি? আমাদের চার পাশের মহাবিশ্বকে জানার একটা উপায় হিসেবে বিজ্ঞানের সাফল্য যদি অনস্বীকার্য হয় (অতীতে বিজ্ঞানকে কী ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সেই নৈতিক প্রশ্নের উত্তর যা-ই হোক), তা হলে মানুষের সমাজ কি পারে, সমষ্টিগত ভাবে, তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিজ্ঞানের হুঁশিয়ারিকে উপেক্ষা করতে?

তা হলে, যদি বিজ্ঞানকে মেনে নিই, তবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব কী? একটা উত্তর হতে পারে অদৃষ্টবাদী। মানে, এটা তো সত্যি যে বিনাশ যে কোনও প্রজাতিরই ভবিতব্য, এবং আমরা আজ এসেছি আমাদের পূর্ববর্তী প্রজাতিগুলো নিশ্চিহ্ন হয়েছে বলেই। এই ধারণাকে অগ্রাধিকার দেওয়া লোকেরা বলতে পারেন, জীবনে যতটা পারা যায় সুখ নিংড়ে নেওয়া আমাদের কর্তব্য, গ্রহটা যত দিন দিতে পারছে আমরা সব কেড়ে নিই, তার পর যা হবে তার ফল ভোগ করবে পরবর্তী প্রজাতিগুলো।

কিন্তু অন্য ভাবেও ভাবা যেতে পারে। ভূতত্ত্বের বিবরণ বলছে, প্রজাতির জীবনকাল পরিবেশের স্থায়িত্বের ওপর নির্ভরশীল। পরিবেশ ও প্রাণীদের যত বিনষ্ট করব, তত সম্ভাবনা বাড়বে বিপদ-সীমা পেরিয়ে যাওয়ার। পরিবেশ বদলের কিছুটার পূর্বাভাস বিজ্ঞান দিতে পারবে, কিছুটার পারবে না, কারণ সেগুলো বুঝতে পারাই আমাদের ক্ষমতার বাইরে। তাই দরকার যুক্তিবাদী ‘রক্ষণশীল’ উপায়ের শরণ নেওয়া, এই বিপদ-সীমাটায় যাতে আমরা না পৌঁছই, তার প্রাণপণ চেষ্টা করা। তার মানে হল, আমরা নিজেদের কাজের পরিবেশগত মূল্যটা যাচাই করতে শুরু করব, ঠিক যেমন শান্তিনিকেতনের এক ছাত্র আমাদের শিখিয়েছেন, প্রতিটি কাজের সামাজিক মূল্যটাও যাচাই করতে হয়।

রিভারসাইড, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূবিদ্যার অধ্যাপক, বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement