আন্দোলনরত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। —ফাইল চিত্র।
আবার শিরোনামে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। আবার ছাত্রদের সহিত কর্তৃপক্ষের সংঘর্ষ। ছাত্র সংসদের নির্বাচনের বিষয়টিকে ঘিরিয়া কিছু দিন যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া অতি উত্তপ্ত। সেই উত্তাপের মধ্যেই চলিল ছাত্রদের বিক্ষোভ অবস্থান, এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জবরদস্তি জিদের টানাপড়েন। অশান্তির মধ্যে উপাচার্য অসুস্থ হইয়া পড়িলেন, তাঁহাকে হাসপাতালে ভর্তি করিতে হইল। পশ্চিমবঙ্গ নিশ্চয় গৌরব বোধ করিতে পারে। ভারতের শিক্ষাসমাজে অশান্তি-সংঘর্ষ আজ কম নহে। কিন্তু তাহার মধ্যেও কলিকাতা, এবং বিশেষত কলিকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, একটি রেকর্ড তৈরি করিতে চলিয়াছে। যে কোনও উপলক্ষে স্বাভাবিক শিক্ষাপরিবেশ কী ভাবে ধ্বস্ত করিয়া দিতে হয়, সেই রেকর্ড। ছাত্ররা বলিবেন, তাঁহারা রাজনৈতিক চেতনায় ‘সমৃদ্ধ’ বলিয়াই এত বিক্ষোভ সংঘর্ষ। প্রতিপক্ষ বলিবেন, ইহারা দুরাচারী বলিয়াই খামকা এত অশান্তি। আর নিরপেক্ষ দর্শক বলিবেন, রাজনৈতিক চেতনার সহিত কিছু সামাজিক ও সারস্বত চেতনার সংযোগ হইলে পরিস্থিতি এত খারাপ হইত না। আসল কথা, রাখালের পালে এত বার বাঘ পড়িলে রাখালের বিপন্নতা প্রমাণে অসুবিধা ঘটে। নানা বিষয়ে একই রকম উদ্দীপনায় বিক্ষুব্ধ হইতে থাকিলে বিক্ষোভ বস্তুটিরই দাম কমে। তখন সত্যকারের বঞ্চনার ক্ষেত্রটিতেও প্রয়োজনীয় সমর্থন পাইতে অসুবিধা হয়।
ছাত্র সংসদের নির্বাচন নিশ্চয়ই গুরুতর বিষয়, তাহার অভাব নিশ্চয় গুরুতর বঞ্চনা। কিন্তু কোনও বিষয়ে একপক্ষীয় মত যদি এত কঠিন হয় যে তাহার সহিত কোনও বোঝাপড়াই চলে না, তাহা হইলে গুরুতর বিষয়গুলিতেও সমাধানসূত্র অধরা থাকিয়া যায়, এবং বিষয়টি শেষে অসমাধানযোগ্য হইয়া পড়ে। ছাত্রদের কথায় কর্তৃপক্ষকে কান দিতে হইবে, কিন্তু ছাত্রদেরও মানিতে হইবে যে বিশ্ববিদ্যালয় চালাইবে শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষই— আর কেহ নহে। এই মৌলিক শর্তটি না মানিলে কোনও প্রতিষ্ঠানই টিকিতে পারে না। সমগ্র প্রতিষ্ঠানের বিবিধ সুবিধা-অসুবিধার দিক ছাত্রদের খতাইয়া দেখিবার কথা নহে, তাহার সুযোগও থাকে না। এই কাজ কর্তৃপক্ষের। ছাত্ররা মত দিতে পারেন, কিন্তু সেই মত রাখিতেই হইবে, এই জবরদস্তি চলিতে পারে না। বিশ্বের কোনও দেশের কোনও উৎকর্ষমুখী প্রতিষ্ঠানেই তাহা চলে না। পড়ুয়ারা ভাবিয়া দেখিতে পারেন: তাঁহারা যে সব দেশে উচ্চতর বিদ্যা-আহরণ ও গবেষণার জন্য যাইতে উন্মুখ, সেখানকার কোন প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা শিক্ষকদের এমন গালিগালাজ করেন, উপাচার্য বা সহ-উপাচার্যকে এই ভাবে নিগ্রহ করিবার সুযোগ পান? ব্রিটেন আমেরিকা জার্মানি অস্ট্রেলিয়া কানাডা, কোথায় বিশ্ববিদ্যালয় চালাইবার রীতিনীতি ‘রচনা’ করেন ছাত্ররা নিজেরাই?
আর একটি জরুরি কথা। ছাত্রছাত্রীরা সৌভাগ্যবান যে তাঁহারা এমন এক জন উপাচার্য পাইয়াছেন, যিনি বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে ব্যতিক্রমী বলিলে অত্যুক্তি হয় না। অনেক প্রশ্নের উত্তরেই তিনি ছাত্রছাত্রীদের দোষত্রুটি ঢাকিয়া চলিতে চাহিয়াছেন, তাঁহাদের শাস্তির মুখে ঠেলিয়া দেন নাই। হেনস্থা হইবার পরও সত্যকারের শিক্ষকোপম এই উদারতা ও মমত্ব অনেকেই দেখাইতে পারিতেন না, কিংবা, চাহিতেন না। ইহাও বুঝা উচিত যে পরিস্থিতির মধ্যে অনেকখানি রাজনৈতিক চাপ রহিয়াছে। মধ্যস্থ শিক্ষক ও উপাচার্যকে নিগ্রহ করিয়া ছাত্রছাত্রীরা আসলে সেই রাজনৈতিক চাপের সামনে প্রিয় প্রতিষ্ঠানটিকে অরক্ষিত করিয়া দিতেছেন। এ দেশে এখন কম প্রতিষ্ঠানই যাদবপুরের মতো নিবিড় দৃঢ়তায় স্বশাসনের মন্ত্রটিকে আঁকড়াইয়া রাজনৈতিক চাপের মোকাবিলা করিতেছে। সেই ব্যতিক্রমী লড়াইয়ে ছাত্রছাত্রীরা কি বিভীষণ হইয়া উঠিতে চাহেন? সে ক্ষেত্রে আরও বড় বিপদ তাঁহাদের উত্তরাধিকারীদের জন্য, এবং এ রাজ্যের জন্য, অপেক্ষা করিতেছে।