Hemant Soren

পুষ্প নহে, পুস্তক

ইংরাজ সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়রের কথা ধার করিয়া বলা যাইতে পারে, একমাত্র খুনি ব্যক্তিই পুষ্পের রূপে মুগ্ধ হন না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২০ ০০:৩৭
Share:

ছবি: সংগৃহীত

শুভেচ্ছা জানাইতে পুষ্প একটি সাহায্যকারী দ্রব্য। বিবাহ কিংবা জন্মদিন উপলক্ষে পুষ্পস্তবক দিবার রীতিটি চালু। পুষ্প দেখিতে সুন্দর। ইংরাজ সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়রের কথা ধার করিয়া বলা যাইতে পারে, একমাত্র খুনি ব্যক্তিই পুষ্পের রূপে মুগ্ধ হন না। শুভেচ্ছা জ্ঞাপনার্থে দৃষ্টিনন্দন দ্রব্যের উপঢৌকনই বিধেয়। তথাপি, কিঞ্চিৎ ভাবিলেই পুষ্পস্তবকের রূপবৈকল্য প্রতীয়মান হয়। শিশু যেমন মাতৃক্রোড়ে সুন্দর, পুষ্পও তেমন বৃক্ষে। বৃন্তচ্যুত পুষ্প কোনও বিচারেই সুন্দর প্রতিপন্ন হয় না। উহা কদর্যতার নামান্তর। মানুষ যেমন নিজ প্রয়োজন চরিতার্থ করিতেই পরিবেশ ধ্বংস করিয়া থাকে, তেমনই কার্য বটে পুষ্পস্তবক রচনা। এবংবিধ কার্যমধ্যে এই বার্তাটি ঊহ্য থাকে যে, এই গ্রহের যাবতীয় সম্পদ মানুষের ভোগের নিমিত্তে নিবেদিত। উক্ত দৃষ্টিভঙ্গি, আর যাহা হউক, যথাযথ নহে। ইংরাজিতে ‘অ্যানথ্রোপোসেন্ট্রিক’ ভাবনা ইহাকেই বলে। এই ধারণার বশবর্তী হইয়াই মানুষ বহু কাল এবংবিধ বিশ্বাসে স্থিত ছিল যে, তাহার নিজের বাসভূমি যখন পৃথিবী, তখন নিশ্চিত ভাবেই সেই গ্রহটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে আসীন। সূর্য এবং গ্রহ সকল পৃথিবীকে প্রদক্ষিণরত। উক্ত ভ্রান্তিবিলাস আর নাই, তথাপি মানুষ অদ্যাপি এই গ্রহের সম্পদ নিজভোগার্থে যথেচ্ছ ব্যবহারে উদ্যত।

Advertisement

পুষ্পস্তবকের যাথার্থ্য এই সম্পাদকীয়ের মূল বক্তব্য নহে। আলোচ্য বিষয় ভিন্ন। সংবাদে প্রকাশ, ঝাড়খণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হইবার পর শিবু সোরেন-পুত্র হেমন্ত সোরেন শুভেচ্ছাবার্তা এবং পুষ্পস্তবকে ভাসিয়া যাইতেছেন। ইহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। ঝাড়খণ্ডে যে ভাবে তিনি তখততাউস হইতে ভারতীয় জনতা পার্টিকে বঞ্চিত করিয়াছেন, তাহা নিঃসন্দেহে প্রশংসার্হ। তিনি অন্তত মহারাষ্ট্রের শিবসেনা নেতা উদ্ধব ঠাকরে নহেন। শ্রীঠাকরে বিজেপি-সঙ্গসুখ লাভ করিয়া নির্বাচন বৈতরণি পার করিয়াছিলেন। তৎপরবর্তী কালে যেমনই মুখ্যমন্ত্রী কুর্সি লইয়া গন্ডগোল পাকাইয়া উঠিল, তেমনই তিনি বন্ধুসংস্রব ত্যাগ করিয়া তাঁহার পুরানো শত্রুর সহিত হাত মিলাইলেন। অর্থাৎ, আদর্শ অপেক্ষা মুখ্যমন্ত্রী পদ যে বেশি লোভনীয়, তাহাই প্রমাণ করিলেন। হেমন্ত সেই পথে হাঁটেন নাই। এ ক্ষণে সমগ্র ভারতবর্ষের এবং তাঁহার নিজের প্রধান শত্রু যে বিজেপি, তাহা উপলব্ধি করিতে ভুল করেন নাই। সাধুবাদ কিংবা শুভেচ্ছা তাঁহার যথার্থই প্রাপ্য। তথাপি গোল বাধিয়াছে তাঁহাকে শুভেচ্ছাস্বরূপ পুষ্পস্তবক প্রেরণ লইয়া। খবর এই যে, স্তবকের আধিক্য দেখিয়া হেমন্ত যৎপরোনাস্তি বিরক্ত। যাঁহারা তাঁহাকে পুষ্পবর্ষণ করিতেছেন, তাঁহাদের উদ্দেশে তাঁহার বার্তাটি অভিনব। হেমন্ত বলিয়াছেন, পুষ্প নহে, পুস্তক প্রেরণ করুন। হেমন্তের অভিলাষ, তিনি একটি পাঠাগার গড়িবেন, তজ্জন্য রাশি রাশি পুস্তকের প্রয়োজন। সুতরাং, বোকে নহে, তিনি বুক-এর প্রত্যাশী। শুভানুধ্যায়ীগণ কত জন হেমন্তের পরামর্শ শিরোধার্য করিবেন বলা যায় না। তথাপি, ইহা অবশ্যই বলা যায় যে, উক্ত আবেদন প্রচার করিয়া ঝাড়খণ্ডের নবনিযুক্ত তরুণ মুখ্যমন্ত্রী এমন এক বার্তা দিয়াছেন, যাহা এই দুর্দিনে বিরল। আর কোন রাষ্ট্রনেতা ইদানীং কালে এমন করিয়া পুস্তকের মাহাত্ম্যকীর্তনে উদ্যত হইয়াছেন, তাহা ভাবিয়া আকুল হইতে হয়।

অথচ চিরকাল পরিস্থিতি এই কালের ন্যায় পঙ্কিল ছিল না। রাজনীতি এখনকার মতো লোভসর্বস্ব হইয়া উঠে নাই। কারাগার হইতে জওহরলাল নেহরু আপন কন্যার উদ্দেশে যে পত্রগুলি প্রেরণ করিতেন, তাহা পড়িলে বুঝা যায় কী পরিমাণ অধ্যয়ন সেইগুলির পিছনে থাকিত। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, সুভাষচন্দ্র বসু, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখের রচনাবলি পড়িলে বুঝা যায় তাঁহারা কেমন পুস্তকপ্রেমী ছিলেন। আধুনিক ভারতীয় রাষ্ট্রনেতাগণের বুলি এবং আচরণ দেখিয়া বুঝা যায় পুস্তক তাঁহাদের নিকট আবর্জনাবৎ পরিত্যাজ্য। জনসাধারণ অনুকরণপ্রিয়, রাষ্ট্রনেতাগণ যাহা করেন, উহারা তাহাই শ্রেয় জ্ঞান করেন। তাই তাঁহারা জ্ঞানবিমুখ, তথ্যপ্রত্যাশী। অধুনা ফেসবুক-নিপীড়িত যুগে আর কী-ই বা আশা করা যায়? রাষ্ট্রনেতাগণ যদি পুস্তকপ্রেমী হইতেন, তাহা হইলে ভারতে রাজনীতি এত কর্দমাক্ত হইত না।

Advertisement

গ্রিক পণ্ডিতগণ বলিতেন, রাজাকে দার্শনিক হইতে হয়। গ্রন্থ অধ্যয়ন যে দার্শনিক হইবার অন্যতম পদক্ষেপ, তাহাতে সন্দেহ নাই। সমাজের এই ঘোর দুর্দিনে তাই হেমন্ত সোরেনের বার্তাটি অতীব মূল্যবান।

যৎকিঞ্চিৎ

সারা দেশে হইহই প্রতিবাদ চলছে, এই সময় চুপ করে আছেন বলে অমিতাভ বচ্চন গাল খাচ্ছেন। দীপিকা পাড়ুকোন জেএনইউয়ের ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বলে গাল খাচ্ছেন। কঙ্গনা রানাউত জেএনইউয়ের ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়াননি বলে গাল খাচ্ছেন। সেলেবদের সমূহ সঙ্কট। যা-ই করুন, কেউ না কেউ তাঁর সিনেমা/ গান/ নাটক/ গ্রন্থ বয়কটের ডাক দেবে। একমাত্র উপায়, করজোড়ে জানান, প্রকাণ্ড ঠান্ডায় গলা পুরো ধরে গিয়েছে, টুইটার এবং ফেসবুকও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement