সাভারকর জন্মেছিলেন ১৮৮৩ সালে এবং স্বাধীনতার ১৯ বছর বাদে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর লেখা বই হিন্দুত্ব (যেটা বর্তমানে সর্বাধিক আলোচিত বিশেষ রাজনৈতিক কারণে) ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয়, কিন্তু এই বই সর্বসাধারণের নজরে আসার আগে দুটো বিখ্যাত বই তিনি লিখেছিলেন। ১৯০৯ সালে যখন গাঁধীজি দ্য হিন্দ স্বরাজ প্রকাশ করেন, তখন সাভারকর তাঁর বিখ্যাত আলোচনা দি ইন্ডিয়ান ওয়ার অব ইন্ডিপেন্ডেন্স বইয়ের আকারে প্রকাশ করেন। দ্বিতীয় বইটা, মাই ট্রান্সপোর্টেশন ফর লাইফ মূলত আত্মজীবনীধারায় লেখা। এই লেখাতে যে সাভারকরের পরিচয় পাই, তার সঙ্গে তৎকালীন যে কোনও জাতীয়তাবাদী কর্মীর কোনও পার্থক্য পাওয়া যাবে না। তবে এটা ঠিক যে, তিনি গাঁধীর অহিংসাকে মেনে নিতে পারেননি, কারণ তিনি মনে করতেন যে, ইংরেজদের ভারত থেকে তাড়ানোর জন্য হিংসাত্মক প্রতি-আক্রমণ একমাত্র পন্থা। লন্ডনে থাকাকালীন তিনি ‘অখণ্ড ভারত সমাজ’ এবং ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠা করেন। ফ্রি ইন্ডিয়া সোসাইটি-তে গাঁধীকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এখানে গাঁধীজির সঙ্গে সাভারকরের দীর্ঘ বাদানুবাদের বিশেষ বিবরণ পাওয়া যায় না। যদিও সাভারকর যে তাঁর বিরোধী ছিলেন, সেটা গাঁধীজি তাঁর দ্য হিন্দ স্বরাজ-এর একটা সংস্করণে উল্লেখ করেছিলেন। বিরোধিতা ছিল আদর্শগত। সাভারকর ইটালির জননায়ক মাৎসিনির ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন, তাই তিনি গাঁধীজির অহিংসা পদ্ধতি যে মানবেন না, তা খুবই স্বাভাবিক। একটি সরকারি গোপন রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, তিনি একটি বিপ্লবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত এবং দি ইন্ডিয়ান ওয়ার অব ইন্ডিপেন্ডেন্স বইয়ের লেখক। এই বইটার মধ্যে ব্রিটিশ সরকার এক বিধ্বংসী বিপ্লবের রূপরেখা দেখেছিল। তাই তাঁর উপর কড়া নজরদারির সরকারি আদেশ ছিল। এই গোপন রিপোর্টে বলা হয় যে, সাভারকর বইটা ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ করছেন। সেটা ভবিষ্যতে কোনও বিষম বিপদ ঘটাতে পারে, এমন আশঙ্কা ব্রিটিশ সরকার প্রকাশ করেছিল।
এবারে আসি, মুচলেকা দিয়ে আন্দামানের সেলুলার জেল থেকে মুক্তির ইচ্ছা কেন তিনি প্রকাশ করেছিলেন। যদি কেউ মনে করেন তিনি এই মুচলেকা দেওয়ার মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে সাহায্যের অঙ্গীকার দিয়েছিলেন, সেটা কিন্তু খুবই সরলীকরণ হবে, কারণ যে সাভারকর দেশকে মুক্ত করার পণ নিলেন, তিনি হঠাৎ একেবারে উল্টো সুর গাইবেন— যাঁরা ইতিহাসের প্রক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করেন তাঁদের কাছে এটা একেবারেই ছেলেমানুষি ব্যাখ্যা বলে মনে হবে। তিনি যে এক জন সুকৌশলী চিন্তাবিদ, এখানে তারই পরিচয় পাওয়া যায়। যে চিঠিটা ১৯২০ সালে জেল-মুক্তির জন্য দেন (যেটি আজ সহজেই পাওয়া যায়), তার মধ্যে নিহিত ছিল তাঁর এক বিশেষ ভাবনা, যা পরবর্তী কালে তাঁর ভাবাদর্শে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। তাঁর মুচলেকাটি যথাযথ অনুধাবন করলে খুব সহজেই দুটো যুক্তির অবতারণা করা যায়। প্রথমত, সাভারকর বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি যেটাকে মুক্তির রাস্তা ভেবেছেন, তা আসলে অ্যানার্কিজ়ম বা নৈরাজ্যবাদ। তিনি তাই বললেন, আমি বাকুনিনের মিলিট্যান্সি বা জঙ্গিবাদের তত্ত্বের সমর্থক নই, ক্রপটকিনের অরাজকতার ভাবনাচিন্তাকেও প্রশ্রয় দিই না। এর কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তি এই পথ দিয়ে আসবে না।
দ্বিতীয়ত, তা হলে কোন ভাবাদর্শের দিকে তিনি ঝুঁকলেন? এখানে একটা বড় পরিবর্তন সাভারকরের মধ্যে লক্ষ করা যায়। তিনি বলেন যে, তিনি সাংবিধানিক পদ্ধতির মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। এখানে এটা ভাবা বোধ হয় অবান্তর হবে না যে, তিনি ‘রয়্যাল ডিক্লারেশন অব ক্লিমেন্সি’-র সমর্থনে একটা যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি হয়তো-বা ভেবেছিলেন যে, যেহেতু ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা সাংবিধানিক, তাই তা এতটা শক্তিশালী, এবং যাঁরা ব্রিটেনের অধিবাসী তাঁরা সবাই এই ব্যবস্থায় খুশি।
মুচলেকার মধ্যে এমন কিছু বক্তব্য আছে, যাতে সাভারকরকে অন্য ভাবে দেখা যায়। কিন্তু বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁর রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে সহজেই প্রতিভাত হয় যে, মুচলেকা ছিল একটা কৌশলগত প্রচেষ্টা মাত্র। তাঁর মুক্তি হয়েছিল যখন ‘ডিক্লারেশন অব ক্লিমেন্সি’ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গৃহীত হয় এবং সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। ফলে, শুধু সাভারকর নয়, তাঁর সঙ্গে অনেক রাজবন্দিকে আন্দামান ও সেলুলার জেল থেকে ছাড়া হয়। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সাভারকর একটা বিকল্প ভাবাদর্শের রূপরেখা তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন, যা পুরোপুরি গাঁধী-বিরোধী রাজনীতি নয়। তিনি সর্বপ্রথম ভারতীয় চিন্তাবিদ, যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য হিন্দু-মুসলমানদের এক ছাতার তলায় আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর মতে, ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনও বিস্ময়ের বস্তু নয়, একটা লম্বা প্রক্রিয়ার ফসল এই ইংরেজ-বিরোধী মহাযুদ্ধ। নিজের বক্তব্য পরিষ্কার করার জন্য তিনি রামায়ণের সীতাহরণের ঘটনার উল্লেখ করেন, যা হয়তো-বা একটা যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণ হতে পারে, কিন্তু কোনও ভাবে তার উৎস হতে পারে না। রাম-রাবণের যুদ্ধ বুঝতে হলে আমাদের তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার প্রয়োজন। তবেই এই যুদ্ধের কার্যকারণ সম্বন্ধ বোঝা যাবে। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের কারণ হিসেবে তাই তিনি বলেন, যেহেতু ব্রিটিশ সরকার কখনওই হিন্দু-মুসলমানদের যথাযোগ্য সম্মান দেয়নি, তাই ধীরে ধীরে ক্রোধ জমা হচ্ছিল, যা প্রকাশ পায় যখন হিন্দু ও মুসলমান সেনাদের গরুর চর্বি মিশ্রিত গোলা মুখে দিতে বাধ্য করা হয়। তিনি তাঁর ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য আরও গভীরে প্রবেশ করেন। তাঁর মতে, বিদ্রোহী সেনারা গ্রাম-গ্রামান্তরে সাহায্য পান, কারণ সকলের মধ্যে এই ভীতি ছিল যে, ইংরেজরা হিন্দু ও মুসলমানদের খ্রিস্টান করতে চায়। অর্থাৎ তাঁদের ধারণা হয়েছিল যে, ইংরেজরা পরিকল্পনা করে এমন বহু পদক্ষেপ করছেন, যার লক্ষ্য হিন্দু এবং মুসলমানদের ধর্মচ্যুত করা। এই ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে তিনি এই তত্ত্বের অবতারণা করলেন যে, মানুষের মানুষ হিসেবে বাঁচার জন্য প্রয়োজন স্বধর্ম এবং স্বরাজ, অর্থাৎ স্বাধীনতা। তিনি ইটালির ইতিহাস থেকে উদাহরণ দেন তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে। তাঁর মতে, মাৎসিনি ইটালির মানুষকে জাগাতে পেরেছিলেন, কারণ তিনি সকলের মনে ধর্মাভিমান এবং জাত্যভিমানের মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য এক অদম্য আগ্রহ জাগাতে পেরেছিলেন।
কিন্তু ১৮৫৭ সালের আন্দোলনে সাফল্য এল না। তার কারণ, সাভারকরের মতে, বিশ্বাসঘাতকতা। প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ ব্যর্থ হলেও ঐতিহাসিক দিক থেকে এর মূল্য অপরিসীম। সাভারকরের মতে, যদিও বিশ্বাসঘাতকদের সহায়তার ফলে এই বিপ্লবকে দমানো গেল, কিন্তু এই স্বাধীনতা যুদ্ধ ভারতবাসীকে এক সূত্রে বাঁধতে পেরেছিল। তাঁর মতে, ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, যাতে শুধুমাত্র হিন্দু ও মুসলমান এক হতে পেরেছিলেন তা-ই নয়, হিন্দুদের মধ্যেও ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের বিভাজন দূর করে একাসনে সবাইকে আনতে তা সমর্থ হয়েছিল। তাঁর ভাষায় ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে জাতি-ধর্ম-শ্রেণি নির্বিশেষে ভারতমাতার সেবায় সবাই নিয়োজিত হয়েছিলেন, যা একটা সামান্য ঘটনা নয়— এক ঐতিহাসিক বিবর্তন, যা ভারতের পরবর্তী ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে।
উপাচার্য, বিশ্বভারতী