প্রতীকী ছবি।
পুলিশ বিভাগের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী কি রান্নাও করিবেন? সম্প্রতি কিছু কর্মী রন্ধনে আপত্তি করিয়া চিঠি দিয়াছেন। তাহাতেই এক পুরাতন সমস্যা ফের সম্মুখে আসিল। কর্মীদের দাবি, রান্না করিবার বা বাসন ধুইবার কাজ করিতে তাঁহারা ‘গ্রুপ ডি’ হিসাবে পুলিশে যোগ দেন নাই। পুলিশকর্তারা উত্তর দিয়াছেন, কোনও কাজই অসম্মানের নহে। বাস্তবিক, এমন উচ্চ আদর্শের বিরোধিতা কে করিতে পারে? বিদ্যাসাগর মহাশয় ছাত্রাবস্থায় স্বহস্তে রান্না করিতেন, মহাত্মা গাঁধী মলমূত্রও অপসারণ করিয়াছেন, প্রফুল্লচন্দ্র রায় মাটি কোপাইতে ভালবাসিতেন। পার্থক্য সামান্য। ইঁহারা নিজে আদর্শের আচরণ করিয়া অপরের সম্মুখে দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছিলেন। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তারা অধীন কর্মীদের রাঁধিতে, বাসন ধুইতে, শ্রমসাধ্য সকল কাজ করিতে বাধ্য করেন। দৈহিক পরিশ্রমের কাজ অসম্মানের নহে, কিন্তু তাহাকে সরকারি চাকরির শর্ত করিয়া তোলা অন্যায়। সাফাই কিংবা রন্ধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সন্দেহ নাই। কিন্তু সমাজ এই কাজগুলিকে মর্যাদা দিতে শেখে নাই। কর্মীকে তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই সকল কাজে নিযুক্ত করিলে কর্মচারী বা কাজ, কাহারও সম্মান বৃদ্ধি পাইবে না। ‘গ্রুপ ডি’ অদক্ষ কর্মচারীর পদ বটে, কিন্তু সেই কর্মীদেরও কর্তব্যে বিভাজন রহিয়াছে। ‘যাহা বলিব তাহাই করিবে’, ইহা কখনও কাজের শর্ত হইতে পারে না। পুলিশ ক্যাম্পে রাঁধুনির প্রয়োজন হইলে রন্ধনে পারদর্শীকেই নিযুক্ত করিতে হইবে। সাফাইয়ের প্রয়োজন হইলে সাফাইকর্মীকে। মহৎ আদর্শের দোহাই দিয়া লাভ নাই।
কিন্তু অধস্তনের অসম্মানই এই ক্ষেত্রে প্রধান প্রশ্ন নহে। সঙ্কট আরও গভীর। পুলিশ ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্তারা চির কালই সরকারি বেতনপ্রাপ্ত কর্মীদের ব্যক্তিগত পরিচারক হিসাবে ব্যবহার করিয়া আসিতেছেন। করদাতার টাকায় বেতন পাইয়া ওই কর্মীরা বাবুর বাগান, ঘর সাফ করিতেছেন। রান্না হইতে শিশুর পরিচর্যা, সকলই তাঁহাদের ‘ডিউটি’। নিঃসন্দেহে ইহা ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার। সাহেবদের গোলামি ঘুচাইতে এই দেশের মানুষ অনেক রক্ত বহাইয়াছে। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসনে অভিষিক্ত দিশি ‘সাহেব’ এক পৃথক প্রজাতি। স্বদেশের চাকরিপ্রার্থীকে গোলামি হইতে মুক্তি দিতে তাঁহারা নারাজ। এই সকল বাবুরা একাধারে বিলিতি সাহেব এবং দিশি জমিদারের ভূমিকা সযত্নে পালন করিতেছেন।
বিনীত প্রশ্ন, বাবুরা সপ্তম (অথবা পঞ্চম) পে কমিশনের সুবিধা পাইবার পরেও তাঁহাদের বাবুর্চি-আর্দালির বেতনভার দুঃস্থ দেশবাসীকে কেন বহিতে হইবে? জনগণের টাকায় সরকারি মন্ত্রী বা আধিকারিকদের পরিচারক নিয়োগের রীতি ব্রিটেনের সাহেবরাও ত্যাগ করিয়াছে। প্রধানমন্ত্রীর পদ হইতে ইস্তফা দিবার পরে ডেভিড ক্যামেরন স্বহস্তে সরকারি বাসভবন হইতে মালপত্র সরাইয়াছেন। অতএব অপচয় বন্ধ হউক। কোন দফতরে কত কর্মী দরকার, তাহা ফের বিবেচনা প্রয়োজন। যখন পুলিশকর্মীর অভাবে মামলা জমিতেছে, তদন্ত সম্পূর্ণ না হইবার জন্য চার্জশিট দাখিল হয় না, বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা কমিবার ইঙ্গিত নাই, তখন কেন কর্তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গ্রুপ ডি প্রয়োজন? পুলিশে গ্রুপ ডি কর্মী কত প্রয়োজন, কেনই বা প্রয়োজন, তাহার মূল্যায়ন করিতে হইবে নবান্নকে।