আসানসোল-দুর্গাপুর অঞ্চলের কয়েকটি শিকারি পাখি। (১) কড়টিয়া। (২) নিম প্যাঁচা। (৩) চুহামার। (৪) শিকরা। ছবি: লেখক
আমাদের সবার খাবার অভ্যাস এক নয়। এ কথা পাখিদের ক্ষেত্রেও খাটে। কোনও পাখি খায় ফুলের মধু তো কেউ ফল। কারও পছন্দ মাছ, মাংস পোকামাকড় আর অন্য পাখির ডিম। অবশ্য নিরামিষ, আমিষ দুইই খায় এমন পাখিও আছে। তাদের সর্বভুকের তালিকায় রাখা যায় স্বচ্ছন্দে। এমন সব পাখিদের নিয়ে আমাদের প্রাত্যহিকী। মাছ, মাংস, পোকামাকড়ের শিকার করে যারা জীবন কাটায় তাদের শিকারি পাখি বলে। ইংরাজিতে র্যাপ্টর। কিছু শিকারি পাখি আছে যারা সারা বছর আমাদের আশেপাশেই থাকে। কেউ কেউ আবার শীতের সময় পরিযায়ী হয়ে আসে আমাদের দেশে। নিশাচর জীব প্যাঁচাও শিকারি পাখির তালিকায় পড়ে। এরাও শিকার করা মাংসের উপরে নির্ভর করে জীবন কাটায়। এই পৃথিবীতে বিভিন্ন জীবজন্তুদের নিয়ে আমাদের বাস। তাদের মধ্যে পাখির সঙ্গে আমাদের সখ্যতা বেশি। সকালে ঘুম ভাঙা থেকে রাতে শুতে যাওয়া অবধি এরা দিন যাপনের সঙ্গী।
বিভিন্ন পাখির দৈহিক গঠন বিভিন্ন। জীবনযুদ্ধে জয়ী থাকতে প্রকৃতি সবাইকে নানা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। যারা ফুলের মধু খেয়ে বেঁচে থাকবে তাদের চঞ্চু মধু বা ফুলের রস পানের উপযুক্ত নলের মতো। আবার যারা ফল কামড়ে খাবে তাদের জন্য ভোঁতা ঠোঁট। কিন্তু যাদের খাবার মাছ, মাংস তাদের জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি বাঁকানো ধারালো চঞ্চু, মাংস ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য। শুধু ঠোঁট নয়, পায়ের মাংসপেশির গঠন আর নখের আকারও শিকার ধরার জন্য উপযুক্ত। শিকারি পাখিদের আপাত দৃষ্টিতে হিংস্র, কুদর্শন মনে হলেও এরা আমাদের বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এরা এক দিকে যেমন বাস্তুতন্ত্রের শীর্ষে অবস্থান করায় অন্যান্য প্রাণীদের (যাদের শিকার করে) সংখ্যাকে নির্দিষ্ট হারে রাখতে সাহায্য করে। অন্য দিকে, শকুনের মতো শিকারিরা মড়া পচা গলা জীবদেহ খেয়ে চারপাশ পরিষ্কার রাখে। তাই এ কথা মানতেই হয় যে, আমাদের পরিবেশে এদের গুরুত্ব অপরিমেয়। কিছু শিকারি পাখি ধান খেতের কাছাকাছি থাকে এবং তাদের প্রিয় খাবার মেঠো ইঁদুর। তাই মাঠের ইঁদুর শিকার করে এরা আমাদের চাষি বন্ধুদের সাহায্য করে পরোক্ষ ভাবে। কিন্তু আমাদের হাতে হওয়া অনিয়মিত প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও নাগরিক সভ্যতার যূপকাষ্ঠে এরাও বলি হয়েছে অন্য জীবদের মতোই। তাই নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থে আজ প্রয়োজন এদের অস্তিত্ব রক্ষা করা আর
তার জন্য এই স্বল্প পরিসরে জেনে নেওয়া এদের সম্পর্কে।
কত নিপুণ এদের শিকারের পদ্ধতি। কী ধৈর্য! কী অসাধারণ ক্ষিপ্রতা! আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এদের দৃষ্টিশক্তি। দূর থেকে শিকারকে ধাওয়া করে ঠিক সময়ে আক্রমণে ধরাশায়ী করে। ঘরের পাশের নারকেল বা অশ্বত্থ গাছে বসে থাকা শিকরা নামে ছোট্ট বাজটার ভয়ে তটস্থ থাকে চড়ুই, পায়রা থেকে শালিক সবাই। এক মাত্র ফিঙে আর কাকেরা সাহস দেখিয়ে ধাওয়া করে দূর ভাগিয়ে আসে ওকে। তবে তার চালাকির নাম করতেই হয়। ঠিক ফন্দি, ফিকির করে তুলে আনে কোকিল বা কণ্ঠীঘুঘুদের বাসা থেকে সদ্য ডিম থেকে বেরোনো ছানাদের। আর বিকেলের শেষটায় যখন বাতাসীরা হাওয়ায় ভেসে মশা ধরে তখন ঠিক তাল বুঝে দু’একটার ঘাড় মটকায়। তবে শিকরা পাখিরা কিন্তু একটির বেশি দু’টি এক সঙ্গে থাকে না, প্রজনন ঋতু ছাড়া। আর এলাকা দখলের জন্য চলে হাওয়ায় ভেসে লড়াই। মাঠের মধ্যে কড়টিয়া (পাতি শিকারে বাজ এবং পোকামার নামেও পরিচিত) আর কাপাসিদের হাওয়াই কসরত দেখলে মন ভরে যায়। আসলে এরা হাওয়ায় ভেসে মাঠে থাকা সরীসৃপ বা ছোট স্তন্যপায়ীদের লক্ষ করে আর শিকার নিশ্চিত ভাবে ঠিক করলেই ঝুপ করে নেমে এসে পায়ের নখের সাহায্যে তুলে নিয়ে যায়। আসলে এদের শরীরের সবটা শিকারের অনুকূল করে তৈরি। সূচাল বাঁকানো ঠোঁট, ধারালো শক্তপোক্ত নখ, প্রখর দৃষ্টি শিকার ধরতে এবং খাওয়ার উপযোগী করে তোলার জন্য। ভারতে মোট প্রায় ১,৩০০ প্রজাতির পাখির মধ্যে ৮০টি প্রজাতি শিকারি পাখির গোষ্ঠীভুক্ত। প্যাঁচারাও এই তালিকায় পড়ে। এরা মাঠেঘাটে, বনে-বাদাড়ে, এমনকি পাহাড়ে নদীর ধারে সব জায়গায় থাকতে অভ্যস্ত। কিছু শিকারি পাখি প্রতি বছর ভারতে আসে। এদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য আমুর ফ্যালকনের নাম। আমি আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে পাখিদের উপরে আট বছর কাজ করে প্রায় ১৮০টি প্রজাতির পাখি পেয়েছি। যাদের মধ্যে শিকারি পাখির সংখ্যা ১৯টি। এদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য পেরিগ্রিন ফ্যালকন এবং রেড-নেকড ফ্যালকন প্রজাতির শিকারি পাখি দু’টি। এ ছাড়াও, কমন কেস্ট্রাল (কড়টিয়া), ইউরেশিয়ান মার্স হ্যারিয়ার (পানচিল), পায়েড হ্যারিয়ার (পাহাতাই), লং-লেগড বাজার্ড (চুহামার), উৎক্রোশ বা মাছমোড়াল (অস্প্রে) প্রভৃতি শিকারিদের উল্লেখ করতেই হয়। প্যাঁচাদের মধ্যে এই অঞ্চলের বিশেষ প্রাপ্তি শর্ট-ইয়ার্ড আউল এবং ইন্ডিয়ান ইগল আউল। শীতের সময় অস্প্রের মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য ক্যামেরা-বন্দি করতে ভিড় জমে যায় পূর্বস্থলীর ভাগীরথীর চরে। শিকারি পাখিদের মধ্যে শিকরা, ব্ল্যাক-সল্ডার্ড কাইট, কেস্ট্রাল, লং-লেগড বাজার্ডের বসা অবস্থায় ছবি পেলেও বেশিরভাগ শিকারি পাখিদের তুলতে হয়েছে উড়ন্ত অবস্থায়। আসলে শিকারি পাখিরা স্বভাবে একাকী প্রকৃতির হয়। তাই ভিড় দেখলেই পগাড়পার। ছবি তোলার শুরুর দিকে দেখেছি ব্ল্যাক কাইটের (চিল) দলকে মাংসের দোকানের কাছাকাছি থাকতে। মানুষজনকে উপেক্ষা করে কী সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে আসানসোল ও রানিগঞ্জের নাগরিক সমাজের সঙ্গে। আসলে অন্য জীবের মধ্যে পাখিরাও আজ বিপন্ন আর সেই বিপন্নতার তালিকা থেকে বাদ নেই শিকারি পাখিরাও। শুধু দ্রুত প্রাকৃতিক পরিবর্তন নয়, এর সঙ্গে আছে শিকারি পাখিদের মধ্যে প্যাঁচাকে নিয়ে মানুষের কুসংস্কার। এখনও অনেক জায়গায় প্যাঁচার খুলি ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন তন্ত্র সাধনায়। পেরিগ্রিন ফ্যালকন, শাহী ফ্যালকন, রেড-নেকড ফ্যালকন প্রভৃতি সুন্দর দেখতে শিকারি পাখিদের বহু জায়গায় পোষ মানিয়ে রাখার রীতি আছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী এরা প্রত্যেকেই সুরক্ষিত থাকার কথা হলেও এরা কেউ সুরক্ষিত নয়। এ ছাড়াও, রয়েছে খাবার এবং বাসস্থানের অভাব। কীটনাশকের ব্যবহার ফলন বাড়ালেও তাদের প্রাকৃতিক আহার কেড়ে নিয়েছে। আমাদের সুউচ্চ আবাসন বা শপিং মলের ভারে হারিয়ে যাচ্ছে ওরা। হয়ত আগামী দিনে ওদের দেখতে ঘাঁটতে হবে ওয়েবপেজের পাতা।
শিক্ষক, সিহারসোল নিম্ন বুনিয়াদী বিদ্যালয়