প্রতীকী ছবি
ঘটনাটা দিল্লির। কিন্তু সমস্যাটা আমাদের সবার। একটু খুলেই বলা যাক। ২০১৫ সালের কথা। টাটা পাওয়ার দিল্লি ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ওয়েবসাইটের খবরের উপর ভিত্তি করে ন্যাশানাল গ্রিন ট্রাইবুনালে সে বার একটা আবেদন জমা পড়েছিল। আবেদনটি ছিল রিভার্স অসমোসিসযুক্ত ওয়াটার পিউরিফায়ারের যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে।
জল বিশুদ্ধিকরণের ক্ষেত্রে রিভার্স অসমোসিস একটি কার্যকর পদ্ধতি হলেও এই পদ্ধতিতে জলের অপচয় ব্যাপক। সাধারণ ভাবে এক লিটার পরিশুদ্ধ জল পেতে এখানে তিন থেকে চার লিটার জলের প্রয়োজন হয়। আবেদনটিতে জানানো হয়েছিল, দিল্লি জুড়ে ব্যাপক ভাবে লাগানো এই ‘আর ও’ মেশিনের জন্য প্রতিদিন গড়ে অপচয় হয়ে চলেছে ২৩২৫০০ লিটার জল। পানীয় জলের বর্তমান সঙ্কটের প্রেক্ষিতে এটা নিঃসন্দেহে ভয়াবহ এক ব্যাপার।
গত বছর ডিসেম্বর মাসে বিষয়টি গ্রিন ট্রাইবুনালে ওঠে। বিষয়টি জরুরি মনে হওয়ায় একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা করে এ বছরের এপ্রিলে। সেই রিপোর্ট খতিয়ে দেখে মে মাসে ট্রাইবুনাল সরকারকে নির্দেশ দেয়, যে সব অঞ্চলে TDS (Total Dissolved Solids) প্রতি লিটার জলে ৫০০ মিলিগ্রামের কম সে সব জায়গায় রিভার্স অসমোসিস ওয়াটার পিউরিফায়ার যাতে ব্যবহার না করা হয় তা দেখার জন্য। শুধু তাই নয়, রিভার্স অসমোসিস ওয়াটার ফিউরিফায়ারকে অনুমোদন দেওয়ার আগে কোম্পানিগুলোকে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, কম করেও ৬০ শতাংশ জল যাতে পুনর্লাভ করা সম্ভব হয়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যা হয়, এখানেও দেখা যায় নির্দেশ রূপায়ণে সরকারি ঢিলেমি। তবে তার উপরেও যেটা হয়, রিভার্স অসমোসিস ওয়াটার পিউরিফায়ারের হয়ে দ্য ওয়াটার কোয়ালিটি অ্যাসোসিয়েশন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় ট্রাইবুনালের নির্দেশের বিরুদ্ধে। ট্রাইবুনালের ঘোষিত নিষেধাজ্ঞার উপরে স্থগিতাদেশের আবেদন জানায় তারা।
সুখের কথা, এই নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টে কেসটি উঠলে কোর্ট তাদের আবেদন প্রত্যাখান করে ১০ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র-সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরে গিয়ে যা বক্তব্য তা বলার নির্দেশ দেয়। এ দিকে ট্রাইবুনালের নির্দেশ কার্যকর করতে হবে এই বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই। এখন দেখার সরকার এ ব্যাপারে কতটা কী করে।
জল নিয়ে দিল্লির পুরো এই ঘটনা থেকে অনেকগুলো বিষয় উঠে এসেছে। প্রথমত, জলের বিশুদ্ধতা। রিভার্স অসমোসিস পদ্ধতি আর্সেনিকের মতো ক্ষতিকারক জিনিস জল থেকে পুরোপুরি দূর করতে পারে কি না সেটা নিশ্চিত নয়। কিন্তু যা করে সেটা হল TDS এর মাত্রা কমানো। কিন্তু TDS এর মাত্রা ১৫০ এর নীচে এলে প্রয়োজনীয় খনিজগুলো এতটাই কমে যায় যে তা শরীরের উপকারের চাইতেও অপকার করে বেশি। WHO এর মতে, TDS যদি জলে প্রতি লিটারে ৩০০ মিলিগ্রামের এর নীচে হয় তবে তা ‘fair’, ৩০০ থেকে ৬০০ মিলিগ্রামের মধ্যে হলে ‘good’, ৬০০ মিলিগ্রামের বেশি হলে ‘poor’।
সুতরাং সর্বত্র এই রিভার্স অসমোসিস ওয়াটার পিউরিফায়ার অপ্রয়োজনীয়। বিশেষ করে নদী বা জলাশয় থেকে যখন জল বিশুদ্ধিকরণ করা হয় তখন ওই জলে TDS এমনিতেই কম থাকে। সেখানে রিভার্স অসমোসিস অপ্রয়োজনে জলের অপচয় ও দূষণ দুই-ই ঘটায়।
আজকাল সব জায়গাতেই নাগরিক জীবনযাত্রার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে ওয়াটার পিউরিফায়ার। কিন্তু রিভার্স অসমোসিসযুক্ত ওয়াটার পিউরিফায়ার যে বিপুল পরিমাণ উচ্চ TDS যুক্ত জল বর্জন করে তা দিয়ে বাসন ধোয়া, গাড়ি ধোয়ার মতো কাজ অনায়াসে করা যায়। কিন্তু সে সব না করা হলে এই জল সরাসরি গিয়ে মেশে ভূগর্ভস্থ জলে। স্বাভাবিক ভাবেই দূষিত হয় সে-জল।
এমনিতেই সারা বিশ্ব জুড়েই এখন নিরাপদ পানীয় জলের সঙ্কট। আমাদের দেশে ১৬৩ মিলিয়ন লোকের কাছে এখনও অধরা থেকে গেছে সুপেয় জল। অপ্রয়োজনে যথেচ্ছ রিভার্স অসমোসিস যুক্ত ওয়াটার পিউরিফায়ারের ব্যবহার সেখানে এই সঙ্কট যে আরও বৃদ্ধি করবে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই!
ট্রাইবুনালের বিশেষজ্ঞ কমিটির আরও কিছু অবলোকন উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন, যে কার্টিজ মেশিনে ব্যবহার করা হয় তা পরিবর্তনের সময় সার্ভিসিংয়ের লোকেরা সংগ্রহ করে নিয়ে যায় না। এই কার্টিজ শেষ পর্যন্ত ফেলে দেওয়া হয় যেখানে সেখানে। এ ছাড়া উচ্চ আর্সেনিকপ্রবণ এলাকায় বর্জিত পদার্থ ভূত্বকে গিয়ে মেশে। ফলে দূষিত হয় মাটি, ভূপৃষ্ঠের জল। বিপদ ঘটায় গাছপালা এবং জীবকুলের।
ঠা ঠা রোদ্দুরে ‘জল পাই’ কোথায় বলে নাকাল হওয়া পথিকের গল্প আমরা সবাই জানি। জলের আর এক নাম যে জীবন, নাকাল হওয়া তৃষ্ণার্ত পথিক সে দিন ভালই বুঝেছিল। জীবন রক্ষক পানীয় জল যদি দূষিত হয় তবে তা পান করা যেমন মরণেরই শামিল, তেমনই জলকে দূষণমুক্ত করতে গিয়ে আমরা একটু বেশিমাত্রায় সচেতন হয়ে অন্য বিপদ ডেকে আনছি কি না, সেটাও কিন্তু ভেবে দেখা দরকার।
শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল