COVID-19

করোনা সংক্রমণ সত্যি কমছে কি না, সেটা জানার উপায় কী

যত বেশি মানুষের মধ্যে পরীক্ষা করা যাবে, তত বেশি করে রোগটির স্বরূপ উদ্‌ঘাটন সম্ভব হবে।

Advertisement

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:২৩
Share:

ফাইল ছবি

ঠেকেও শিখছে ন না কেউ।
কোনও সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের (সে যতই সামান্য বা কোভিড-১৯’এর মতো বিপজ্জনক হোক না কেন) মূল ভিত্তি হল সমাজের সব স্তরে রোগের উপস্থিতি নিয়ে লাগাতার সমীক্ষা চালানো। যত বেশি মানুষের মধ্যে পরীক্ষা করা যাবে, তত বেশি করে রোগটির স্বরূপ উদ্‌ঘাটন সম্ভব হবে। রোগটির স্বরূপ জানা গেলে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রূপরেখা তৈরিতে সুবিধা হবে। এটিই জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল ভিত্তি।

Advertisement

দেশের স্বাস্থ্যনীতি প্রণেতারা এটা জানেন না, তা নয়। কিন্তু রোগ সংক্রমণের ব্যাপকতা আড়াল করতে গিয়ে জনস্বাস্থ্যের মূল বিষয়টিকেই উপেক্ষা করা হয়। কলকাতার একটি কেন্দ্রীয় সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এক অবসরপ্রাপ্ত পরজীবী বিজ্ঞানীর মন্তব্য, ‘‘কোথাও একটা সংক্রমণ দেখা দিলে তখন থেকেই সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রশাসনের উচিত যথাসম্ভব বেশি মানুষের রক্ত বা অন্য জৈবরস পরীক্ষা করে সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া। রোগ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত একই হারে সমীক্ষা চালিয়ে যেতে হয়।’’ আইসিএমআর-এর অবসরপ্রাপ্ত এক বিজ্ঞানী বলছেন, ‘‘কোনও রোগ সংক্রমণ কমতে শুরু করলে স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে কিছুটা শিথিলতা আসে। তাই সমীক্ষার হার আশঙ্কাজনক ভাবে কমে যায়। সেই ফাঁক দিয়ে কখন সংক্রমণ আবার ছড়িয়ে পড়ে তা ধরা যায় না।’’

এ দেশে অতীতে ম্যালেরিয়া, পোলিও, যক্ষ্মা সংক্রমণের ক্ষেত্রে এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে। আফ্রিকায় একাধিক সংক্রমণের ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রশাসনিক শিথিলতা রোগ পরিস্থিতি জটিল করেছে বলে আইসিএমআর-য়ের প্রাক্তন কর্তা জানিয়েছেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা দেশেই কয়েক সপ্তাহ ধরে কোভিড-১৯ ভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু সংক্রমিতের হার কমেছে কি? পরীক্ষার হার অত্যন্ত কমে যাওয়াতে এই প্রশ্নের জবাব মেলেনি। পুজোর আগে-পরে কলকাতার বিভিন্ন ওয়ার্ডে কোভিড পরীক্ষার শিবির বসেছিল। বিনা পয়সায় সেখানে গিয়ে যে কোনও মানুষ কোভিড পরীক্ষা করাতে পারতেন। কিন্তু ওই প্রক্রিয়ায় আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। দক্ষিণ কলকাতার এক হতাশ কাউন্সিলর বলছেন, ‘‘পরীক্ষা শুরু হওয়ার সাতদিন আগে থেকে এলাকায় মাইকে প্রচার করিয়েছি। যতদিন পরীক্ষা চলেছে, ততদিন ঘোষণা চলেছে। কিন্তু মানুষের কাছ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পাইনি। ধরেবেঁধে কয়েকজনকে নিয়ে এসে শিবির চালু রাখতে হয়েছে। তাই যে পরিমাণ পরীক্ষা হওয়ার কথা, তা হয়নি।’’ কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা কমায় কাউন্সিলররা শিবির চালু রাখার যৌক্তিকতা খুঁজে পাননি। এক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মন্তব্য, ‘‘মহামারীর মতো অবস্থায় সুযোগ পেয়েও পরীক্ষা না করাটা অপরাধ। সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য না করার অভিযোগে মহামারী নিয়ন্ত্রণ আইনে কিন্তু এই সব অসহযোগী নাগরিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সংস্থান রয়েছে।’’ আসলে মহামারীর ক্ষেত্রে পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলে মানুষ এ ভাবে সুযোগ হারানোর বিলাসিতা হয়তো করতেন না। পশ্চিমবঙ্গে অবশ্য কোনও আইন মানতে বাধ্য করার প্রশাসনিক দাওয়াই কোনও সময়েই সক্রিয় নয়। আর এবার তো সামনে ভোট!

Advertisement
আরও পড়ুন:

কোভিড সংক্রমণে এ রাজ্যে মৃত্যুহার দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ হওয়া সত্ত্বেও মহামারী আইন ভাঙায় পশ্চিমবঙ্গে শাস্তিপ্রাপ্তের সংখ্যা সব থেকে কম। কারণ, এই রাজ্যে আইন মানা এবং আইনভঙ্গকারীদের দণ্ড দেওয়ার সংস্কৃতি তেমন গড়ে ওঠেনি। এ রাজ্যের মানুষ নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার নিয়ে খুবই সরব। তবে এই গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষদের জন্য অন্য কারও যে ক্ষতি হতে পারে, তা ভাবেন না রাজ্যের মানুষ। নির্বাচন এলে এই ব্যধির প্রকোপ বাড়ে। সংক্রমণ বাগে আসার আগেই ভোটের দামামা বেজে গিয়েছে। নির্বাচনের কথা ভেবেই আমফানের ত্রাণ নিয়ে মিছিল, পাল্টা মিছিলে সরগরম হয়েছে কলকাতা। বাধা পেলে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রাস্তায় বসে পড়েছে জনতা। বেশির ভাগই মাস্ক- সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং-স্যানিটাইজেশনের ধার ধারেননি। কিন্তু যাঁরা ওই ভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়ার পর পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন, তাঁদের একজনকেও সাজা দেওয়া গেল না।

পুজোর পর শুরু হল রাজনৈতিক সভা। রাজ্যের বাইরের নেতারা আসতে শুরু করলেন। শুরু হল রোড শো। অতিমারী তখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি! রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান জানাচ্ছিল, আক্রান্তের সংখ্যা কম। তাতেই সাহস বেড়ে যায় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের। এক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘ওই সব ক্ষেত্রে প্রতিটি জমায়েতে জনতার পরীক্ষা হওয়া উচিত ছিল। তা হলে কার কার দেহে কোভিড জীবাণু বাসা বেঁধেছে, তা পরিষ্কার হত। জনতার মধ্যে কী ভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তা জানার আদর্শ পরিস্থিতি ছিল ওই জমায়েতগুলি।’’

দেশে স্বাস্থ্য গবেষণার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ পথিকৃৎ। কিন্তু স্বাস্থ্য গবেষণার ক্ষেত্রে ক্রমশই পিছিয়ে যাচ্ছে। কোনও সংক্রমণ হলে কোন কোন এলাকা, কোন কোন জনগোষ্ঠী, কোন কোন বয়সের, কোন কোন আর্থ-সামাজিক অবস্থায় সংক্রমণের হার কেমন, তা গবেষণা করে দেখার প্রবণতা তলানিতে এসে ঠেকেছে। রাজ্যের প্রবীণ এক অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্তার আক্ষেপ, ‘‘আসল পরিস্থিতিকে লঘু করে দেখানোর যে সংস্কৃতি রাজ্যে নয়ের দশকে শুরু হয়েছিল, সেটাই এখন অতিমারির চেহারা নিয়েছে। এই সংস্কৃতিতে গবেষণার মানসিকতা যে থাকবে না সেটাই বাস্তব।"

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement