India

সব উটের পাকস্থলী হয়ে যাবে?

কূটনীতির অঙ্ক বেশ কঠিন। তাই অন্য দিক দিয়ে চিনকে সবক শেখাবার আবেগ উস্কানো হচ্ছে।

Advertisement

ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২০ ০০:১৯
Share:

ভারতের ভূখণ্ডে নাকি এক ইঞ্চিও ঢোকেনি চিন-বাহিনী, ভারতের সেনাবাহিনীও নিয়ন্ত্রণরেখা পেরোয়নি। তা হলে দুই বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষটা ঘটল কী ভাবে? এই সব কঠিন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেয়ে নজর ঘুরিয়ে দেওয়া ভাল চাউমিন আর টিকটকের দিকে। করোনার অবসাদ আর পরিযায়ী শ্রমিকের নরকযন্ত্রণার অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে ভক্তকুল তাই ময়দানে নামার রসদ পেয়ে গিয়েছে। মন্ত্রীর ঘোষণা, দেশব্যাপী চিনা খাবারের দোকান বন্ধ করতে হবে। জনগণের চেষ্টা, ফোন থেকে সব রকম চৈনিক চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে। চিনের শাসক ভেবে উত্তর কোরিয়ার শাসকের কুশপুতুল পুড়েছে। ভক্তিরসের প্রাবল্যে উত্তরপূর্বের মানুষের হেনস্থা হওয়ার আশঙ্কাও থাকছে। এর মধ্যে আবার চিনা ফোন কোম্পানির অনলাইন সেল খোলার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে এক লক্ষ ফোন বিক্রির খবর— আত্মনির্ভর ভারতে এ কি অনাছিষ্টি।

Advertisement

কূটনীতির অঙ্ক বেশ কঠিন। তাই অন্য দিক দিয়ে চিনকে সবক শেখাবার আবেগ উস্কানো হচ্ছে। কিন্তু এই আবেগের মধ্যেও তো একটু অঙ্ক থাকার কথা? চিন আর ভারতের মধ্যে কে কার ওপর বাণিজ্যিক ভাবে কতটা নির্ভরশীল? ভারতের বৈদেশিক ব্যবসার ১১% চিনের সঙ্গে। তার মধ্যে আমদানির পাল্লা অনেক ভারী, মোট আমদানির প্রায় ১৭% চিন থেকে। তাতে শুধু সস্তার আলো, খেলনা, ইলেকট্রিকাল বা ইলেকট্রনিক্স (যেমন ফোন, টিভি) নেই। আছে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী, যেমন ওষুধ, কৃষির জন্য কীটনাশক, টেলিকম ও কম্পিউটারের যন্ত্রপাতি, ব্যাটারি-র লিথিয়াম ইত্যাদি। দেশে যে ওষুধ তৈরি হয়, তার ৭৫% কাঁচামাল চিনের, কিছু অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৮৫%। ওষুধ রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের যে সাফল্য, তাতে চিন থেকে সস্তার কাঁচামালের ভূমিকা প্রধান। দেশে কৃষিক্ষেত্রে যে কীটনাশকের ব্যবহার, তার ৮০% কাঁচামাল চিনের। যে টেলিকম শিল্পের হাত ধরে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, ৩জি বা ৪জি, তার যন্ত্রাংশের ৭৫% চিনের। মারুতির মতো সংস্থাতেও চিন থেকে যন্ত্রাংশ না পেলে সমস্যা। ব্যাটারির লিথিয়াম পুরোটাই চিনের, তাছাড়া ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর জন্য জরুরি সেমিকন্ডাকটর আর ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটও। সমস্ত যন্ত্রাংশ চিন থেকে এনে শুধু স্ক্র-ড্রাইভার দিয়ে জুড়ে স্টিকার মেরে দিয়েই ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র শ্লাঘা বোধ হতে পারে। কিন্তু তাতে বাণিজ্যিক নির্ভরতা কমে না।

এছাড়া স্টার্ট-আপ ইন্ডিয়ার পতাকা যারা বহন করছে, তাদের অধিকাংশই চলছে এখন চিনা বিনিয়োগে ও অংশীদারিত্বে। পেটিএম, ফ্লিপকার্ট, ওলা, জ়োম্যাটো, সুইগি, ওয়ো, বিগ-বাস্কেট— সব মিলিয়ে বিনিয়োগ প্রায় চার বিলিয়ন ডলার, কাজ তৈরি হয়েছে প্রায় এক কোটি। তাদের প্রতিও বিদ্বেষমূলক আচরণের খবর আসা শুরু হয়েছে।

Advertisement

অন্য দিকে চিনের দিকের হিসেব হল, ভারতের সঙ্গে তাদের ব্যবসা মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের মাত্র ২%। চিনা সামগ্রীর বাজার আক্ষরিক অর্থে বিশ্বায়িত, তাতে ভারতের স্থান ১২ নম্বরে। তাই দীপাবলিতে চিনা আলো না জ্বালালে, বারান্দা থেকে টিভি ছুঁড়ে ফেললে বা চিলি চিকেন বয়কট করলেই চিনের সর্বনাশ, এমন ভাবনায় ছেলেও ভুলবে কি?

শিল্প উৎপাদনে চিনের প্রতি এই অতিনির্ভরতা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু তার থেকে বেরোবার জন্য কী চাই? চাই শিল্প ও শ্রমনীতিতে সার্বিক পরিকল্পনা, ধৈর্য, উৎপাদন-সংস্কৃতিতে মৌলিক পরিবর্তন— আবেগ-কল্পনার হিস্টিরিয়া নয়। কয়েক দশক ধরে দেশের অর্থনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে চিনা সামগ্রীর নির্ভরতা, তাই কয়েকটি ক্ষেত্র বাদ দিলে (যেমন দু-চাকা গাড়ি) অনেক শিল্পেই এই উল্টো পথ কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদি। আজ থেকে উদ্যোগ নিলে, এবং সরকারের সক্রিয় সাহায্য থাকলে দশ বছর পর কিছুটা সাফল্য পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আজ এই নির্ভরতা সর্বব্যাপী, তাই আজ দাঁড়িয়ে আমদানির ক্ষেত্রে কোনও রকম ব্যাঘাত ঘটলে ওষুধ আর কৃষিপণ্যের দাম অনেক বাড়বে, আরও হাজার হাজার ব্যবসায়ীর ঝাঁপ বন্ধ হবে, ডিজিটাল ইন্ডিয়ার অন্তর্জলি যাত্রা ঘটবে। করোনার ধাক্কায় জর্জরিত ভারতে গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনে আরও আঘাত আসবে।

সহজ কথা— বাণিজ্যিক ভাবে চিনের কেশাগ্র স্পর্শ করার মতো কোনও জায়গায় ভারত আজকে নেই। বরং চিনের কাছাকাছি থাকাই আপাতত ভারতের মানুষের জন্য সুবিধাজনক। সমস্যাটা মূলত কুটনৈতিক। ছয় বছরে দেশের প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বার চিন গিয়েছেন (মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন আরও চার বার), চিনের প্রধান এসেছেন তিন বার। কিন্তু ডোকালাম থেকে গালওয়ান— পরিস্থিতির জটিলতা বেড়েই চলেছে। দক্ষিণ চিন সাগরের আধিপত্য, পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে চিনের মহাসড়ক নির্মাণ, নেপালের আস্ফালন, পাকিস্তানের গ্বাদার বা শ্রীলঙ্কার হাম্বানতোতা বন্দরের অস্বস্তি, মায়ানমারে চিনের আধিপত্য: সব মিলিয়ে চক্রব্যুহের সাঁড়াশি চাপে রয়েছে ভারত। করোনাবিধ্বস্ত ট্রাম্প ভোটে বাঁচতে চিনবিরোধিতার যে জিগির তুলছেন, তাতে সামিল হয়ে ভারত চিনের সঙ্গে সংঘাতের সলতেটা নতুন করে উস্কে দিলে ক্ষতিটা কার, ভাবা দরকার।

নিখিলেশ বিমলাকে বলেছিল, গড়ে তোলার কাজে সবটা শক্তি দিলে যে লাভ, অনাবশ্যক ভেঙে ফেলতে শক্তির বাজে খরচে সেই লাভের সিকি ভাগও নেই। ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে ঠিক এই চিন্তাভাবনাবিহীন বয়কটীয় জাতীয়তাবাদ বিষয়েই ছিল তীব্র উদ্বেগ। আজ আবার ভারত আর এক আত্মঘাতী অবিমৃশ্যকারিতার মোহে হাবুডুবু। করোনাহত দেশের অর্থনীতির পক্ষে কতটা বিপজ্জনক এই প্রবণতা, ভাবলে আতঙ্কিত হতে হয়। আজ অর্থনীতির যে ধংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে ভারত, তার কারণ তো শুধু করোনা নয়, আরও অনেক বেশি মৌলিক। নোটবন্দি আর জিএসটি-র জোড়া অভিঘাত দেশের আর্থিক পরিস্থিতিকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, বেকারত্বের হার বাড়ছিল। এতে খাঁড়ার ঘা দিয়েছে করোনা। এই পরিস্থিতিতে, ৩০ মিনিটের বক্তৃতায় ২৭ বার ‘আত্মনির্ভর’ বললেই চিনের মোকাবিলা করা যাবে না। কূটনীতির ব্যর্থতাকে দেশপ্রেমের শস্তা পাঁচন দিয়ে ‘ম্যানেজ’ করতে গেলে সব কিছুই উটের পাকস্থলী হয়ে যাবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement