প্রবন্ধ ১

না হওয়ার রাজ্যে একটি ব্যতিক্রম

মঞ্জু। রতি। সীমা। গ্রামের গরিব ঘরের মেয়ে। এখন স্বাবলম্বী। পাশে দাঁড়িয়ে সাহস জুগিয়ে স্বাবলম্বন শেখাচ্ছেন আরও অনেককে। এই সাফল্যের রহস্য? ইচ্ছাশক্তি, আর সরকার ও সমাজের ঠিক ঠিক সহযোগিতা।প্রথমা: দারিদ্রের জন্য পড়াশোনা হয়ে ওঠেনি। ঘরের কাজে মা-ঠাকুমাকে সাহায্য করতে হয়েছে। সেলাইফোঁড়াই বা অন্য কাজেরও ফুরসত মেলেনি। বিয়ের পর পিঠোপিঠি দুই ছেলে আর হাঁড়ি সামলাতে চলে গিয়েছে বেশ কয়েকটা বছর। বছর তিরিশের মঞ্জু (দাস) এখন স্বাবলম্বী।

Advertisement

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৫ ০০:০০
Share:

প্রথমা: দারিদ্রের জন্য পড়াশোনা হয়ে ওঠেনি। ঘরের কাজে মা-ঠাকুমাকে সাহায্য করতে হয়েছে। সেলাইফোঁড়াই বা অন্য কাজেরও ফুরসত মেলেনি। বিয়ের পর পিঠোপিঠি দুই ছেলে আর হাঁড়ি সামলাতে চলে গিয়েছে বেশ কয়েকটা বছর। বছর তিরিশের মঞ্জু (দাস) এখন স্বাবলম্বী।

Advertisement

দ্বিতীয়া: রতির (দাস) বিয়ে হয়ে গিয়েছে কম বয়সেই। বাবা পড়াতে পারেননি। বিয়ের পরে পরেই কোলে এসেছে সন্তান। নিজের কথা ভাবার সময় মেলেনি। এখন বছর ছাব্বিশের রতির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নিয়মিত টাকা জমা হয়।

তৃতীয়া: নিজের জন্য যে কিছু করা যাবে, বিয়ের আগে ভাবতেই পারতেন না সীমা (লোহার)। এখন দিব্যি ছুটছেন কলকাতা, দিল্লি, সুরজকুন্ড। মন্ত্রী-আমলা-বণিকসভার সামনে নিজের হাতের কাজের কথা বলছেন। স্বামীকে নিয়ে উঠে এসেছেন ভাড়া বাড়িতে। মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছেন। একুশ বছরের সীমার স্বপ্ন, তিন বছরের মেয়েটাকে যেন দারিদ্রের সঙ্গে যুঝতে না হয়।

Advertisement

— না-হওয়ার, না-পাওয়ার রাজ্যে তিনটি ব্যতিক্রমী মুখ। শুধু নিজেরা স্বাবলম্বী হননি, পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছেন আরও অন্তত ষাট জনকে, অধিকাংশই তৃণমূল স্তর থকে আসা। বীরভূমের বোলপুর লাগোয়া দর্পশীলা, বাহিরি, শীতলপুর, আমপুকুর ডাঙা, আলবান্ধা, শিল্পীপল্লি, কুঠীপাড়া, পাহাড়পুর, গোপীনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা ওঁরা।

কী করেন ওঁরা?

কেউ বাটিকের কাজ করেন। কেউ সুচসুতো দিয়ে কাপড়ে ফুটিয়ে তোলেন নকশা। কারও উৎসাহ বাঁশ কেটে ঘর সাজানোর জিনিস তৈরিতে।

মে মাসের দুপুরে বীরভূমের দেবানন্দপুরে প্রশিক্ষণকেন্দ্র ‘মোরাম’-এ কাঁথায় ফোঁড় দিচ্ছিলেন মঞ্জু। কুশন কভার তৈরি হচ্ছে। পাশে প্রশিক্ষক হিরণজ্যোতি সনওয়াল। অসমের তিনসুকিয়ার যুবক হিরণ বীরভূমের এ গ্রামে এসে নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছেন মঞ্জু, রতি, সীমাদের সঙ্গে। কী ভাবে ফোঁড় দিলে, কী ধরনের সুতো ব্যবহার করলে নকশা আরও প্রাণবন্ত হয়, শেখাচ্ছিলেন। তিনি অবশ্য বলেন, ‘ওঁরা সব শিখে এসেছেন। আমি একটু ঘষেমেজে দিচ্ছি।’ আর মঞ্জু বললেন, ‘হিরণ স্যর প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলেন। আমাদের প্রকৃতি থেকে নকশা তুলে আনতে বলেন।’

মঞ্জু বাইরের লোকের সামনে কথা বলতে পারতেন না। এখন কুড়ি জনের শিক্ষার্থী দলের নেত্রী। সবার হাতের কাজ নিয়ে প্রদর্শনীতে যান। দিল্লি, হরিয়ানায় মেলায় গিয়ে বেচেন। উত্তর-পূর্বের এক আদিবাসী গোষ্ঠীর নকশা তুলতে তুলতে মঞ্জু বলেন, ‘সুচসুতো কখনও হাতে নিইনি। এখন ওই সুচসুতোই মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকা তুলে দিচ্ছে।’

কী ভাবে সম্ভব হল?

‘রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণি দফতরই আমাদের এ ভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছে। ওরা এ ভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করলে আমাদের ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই থাকতে হত। সংসারের অভাব ঘোচানোর জন্য হয়তো কিছুই করতে পারতাম না।’ বললেন সুজাতা টুডু। করেসপন্ডেস কোর্সে বিএ পড়ছেন। মাস গেলে কিছু উপার্জনও করছেন।

বহরমপুর থেকে বাঁশের কাজ শেখাতে এসেছেন প্রতাপ বেজ। কী ভাবে বাঁশের তৈরি আসবাবে রঙ করতে হয়, শেখাচ্ছিলেন কল্যাণী পাত্র, পদ্মাবতী সোরেন, রুপালী হেমব্রমদের। রঙ হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন হলুদগুঁড়ো আর চা পাতা। হলুদ কেন? প্রতাপবাবু বললেন, ‘হলুদের দাগ কি সহজে ওঠে?’ মেয়েদের জবাব: ‘না’। এক জন বললেন, ‘আমার মায়ের গায়ের হলুদের শাড়িটা আলমারিতে তোলা রয়েছে। ত্রিশ বছরেও হলুদের রঙ ওঠেনি।’ স্যর বললেন, ‘আমরা তাই হলুদ রঙটা বেশি ব্যবহার করব।’

আর চা পাতা? ‘ওটা রঙের জেল্লা বাড়াবে, রঙটা বাঁশ আঁকড়ে থাকবে। রঙ চটবে না। বাঁশে পোকাও লাগবে না।’

যে ‘আর্ট ইলিউমিনেটস ম্যানকাইন্ড’ সংস্থার মাধ্যমে ওঁদের প্রশিক্ষণ, তার সম্পাদক সোনালী চক্রবর্তী বললেন, ‘প্রশিক্ষণের টাকা আসে এসসি এসটি ফিনান্স কর্পোরেশন থেকে। রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণি দফতরের মন্ত্রী নিজে থেকে উদ্যোগী হওয়ায় এতগুলি মেয়েকে প্রশিক্ষণ দিতে পারছি। আড়াই বছরে মোরামে অন্তত বারোশো মহিলাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ইচ্ছাশক্তির কী জোর, তা ওঁরা প্রমাণ করেছেন।’ মঞ্জু-রতিরা এখন দ্বিতীয় দফার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। প্রাথমিক প্রশিক্ষণের সময় সপ্তাহে পাঁচ দিন প্রশিক্ষণ নিলে মাসে ৩০০০ টাকা ভাতা পেতেন। এখন পান মাসে ৩৫০০।

প্রশিক্ষণ হয়ে গেলে? সোনালী জানান, ‘বিপণনের প্রশিক্ষণও আমরা দিচ্ছি। ওঁদের পাঠাচ্ছি বিভিন্ন মেলায়।’ পাশ থকে রতি বলেন, ‘আমদাবাদ, রাজস্থান থেকে স্যর, ম্যাডামরা এসে কী ভাবে বিশ্বমানের জিনিস তৈরি করতে হয় তার প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন।’ ঘরে দেখা গেল একটা কম্পিউটার। সীমা বলেন, ‘আমরা শিখছি।’ কেন? সমস্বর জবাব: ‘এখন ইন্টারনেটে সরাসরি মাল বিক্রি হয়। আমরাও আমাদের তৈরি সামগ্রীর ছবি দিয়ে দেব। বিক্রি হবে।’

প্রথাগত পড়াশোনা নেই কারও। কিন্তু যে ভাবে ওঁরা সব বাধা কাটিয়ে এগোনোর পণ করেছেন তা দেখে মনে হল, ওঁদের কেউ আটকাতে পারবে না। রাজ্যের অনগ্রসর শ্রেণি দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘প্রতিটি জেলায় তফসিলি জাতি জনজাতি অর্থ নিগমের অর্থ সাহায্যে নির্দিষ্ট কেন্দ্র রয়েছে। প্রশিক্ষণের পরে সেখানে গিয়ে প্রশিক্ষিতেরা তাঁদের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার জন্য নানা সাহায্য পাবেন: সুতো, কাপড়, রঙ, সেলাই মেশিন, বিনা ঝঞ্ঝাটে কম সুদে ব্যাঙ্ক ঋণ (জনজাতিদের জন্য পুরোটাই অনুদান)।’

তফসিলি অনগ্রসর শ্রেণি দফতরের মন্ত্রী উপেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের দাবি, ‘ওই এলাকায় পিছিয়ে থাকা মানুষদের সামাজিক ও আর্থিক উন্নতি কী ভাবে করা যায় তার জন্য রীতিমতো গবেষণা করেছি আমি। তার পরেই আমার দফতর এই পরিকল্পনা করেছে।’

গবেষণা? কী রকম?

‘ওই অঞ্চলের ইতিহাস প্রায় দু’হাজার বছরের। সেই ইতিহাস বলছে, এ অঞ্চলে নানা হাতের কাজের শিল্পীরা—যেমন বাঁশের কাজ বা সেলাই— এক একটি গোষ্ঠী হিসেবে তাঁদের সামগ্রী তৈরি করতেন এবং বিক্রি করতেন। সচ্ছল জীবন ছিল তাঁদের। আমি সেই সব শিল্পীর উত্তরপুরুষদের ফের সেই কাজে ফিরিয়ে আনতে চাইছি।’ তাঁর বক্তব্য, ‘অনগ্রসর শ্রেণির জন্য চাকরির সংরক্ষণ আছে, কিন্তু তাতে তো কুড়ি শতাংশও উপকৃত হবেন না। সবাইকে একসঙ্গে জীবনযুদ্ধে লড়াই করার সুযোগ দিতেই আমাদের এই ভাবনা। আমি দেখেছি প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরা রীতিমতো আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজেদের শিল্প বাইরে বিক্রি করছেন। এর থেকে বড় সাফল্য আর কী-ই বা হতে পারে!’

ঠিক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement