কলিকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে রাজ্যের অচলাবস্থার নিরসনের পথসন্ধান মিলিল। নির্বাচন প্রক্রিয়ার উপর স্থগিতাদেশ উঠিল। রাজ্যের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরিয়া যে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হইয়াছিল, আশা করা যায় এ বার তাহার পরিবর্তন সম্ভব হইবে, নূতন মনোনয়ন পেশ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্পষ্ট ও সঙ্গত পদ্ধতিতে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়া যাইবে। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলির অভিযোগের যাথার্থ্য এই রায়ে প্রমাণিত। রাজ্য সরকারের পদক্ষেপের মধ্যে যে গণতন্ত্রের বিচারে অসঙ্গত প্রয়াস রহিয়াছে, রায়টিতে তাহারও ইঙ্গিত। আবার মনোনয়ন পেশের পদ্ধতি লইয়া নির্বাচন কমিশন গত কিছু কাল যে অদ্ভুত সিদ্ধান্তসকল গ্রহণ করিয়াছিল, বিরোধী দলগুলির পক্ষ হইতে তাহার তীব্র সমালোচনাও আদালতের রায়ে সমর্থিত। রাজ্য সরকারের নৈতিক পরাজয় লইয়া প্রশ্ন উঠিতে পারে না। তবে, হাইকোর্টের নির্দেশটিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে স্বাগত জানাইয়াছেন, তাহা এই কারণেই আশ্বস্ত করে। বিষয়টিকে লইয়া আরও জলঘোলা না করিয়া বরং আদালতের বক্তব্য মানিয়া তাঁহার সরকার ও নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই নূতন আলোচনা শুরু করিয়াছে। আশা করা যায়, গত পর্যায়ে নির্বাচন কমিশন যে প্রবল দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়াছে, এই পর্যায়ে তাহার পুনরাবৃত্তি ঘটিবে না।
এই রায় হইতে নির্বাচন কমিশন কিছু শিক্ষা লইবে, এমন আশাও থাকিল। বলিবার অপেক্ষা রাখে না, পঞ্চায়েত নির্বাচনের মতো একটি সম্পূর্ণ শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে এ বার বিচারবিভাগ অবধি যাইতে হইয়াছিল কমিশনের বিচিত্র কাজকর্মের জন্যই। আদালত হইতে সুবিচার মিলিয়াছে ঠিকই, কিন্তু আদালত অবধি এই ঘটনাকে টানিয়া লইয়া যাওয়াটাই গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত অনভিপ্রেত। এই অনভিপ্রেত ঘটনা যে শেষ অবধি ঘটিল, তাহার প্রধান দায় নির্বাচন কমিশনকেই লইতে হইবে। যে ভাবে কমিশন মনোনয়ন পেশের সময় কার্যত সমাপ্ত হইবার পর আবার হঠাৎ নূতন করিয়া মনোনয়ন পেশের সময়সীমা বাড়াইয়াছিল, তাহা যুগপৎ অভূতপূর্ব এবং অন্যায়। একটি সমাপ্ত প্রক্রিয়াকে এই ভাবে ইচ্ছামতো যখন-তখন ফিরাইয়া আনিবার যৌক্তিকতা থাকিতে পারে না। আবার, এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরের দিনই হঠাৎ করিয়া মনোনয়ন পেশ বন্ধ করা হইয়াছিল। সব মিলাইয়া, পশ্চিমবঙ্গের এ বারের পঞ্চায়েত ভোটের এই প্রাথমিক পর্ব কিছু উদ্বেগজনক সঙ্কেত দিয়াছে। তাহা হইল— প্রথমত, এ রাজ্যে আইনের শাসন পদার্থটি নিতান্ত দুর্বল এবং দ্বিতীয়ত, নির্বাচিত সরকারের কিংবা নির্বাচন কমিশন নামক প্রতিষ্ঠানটির, কাহারও তরফে দেশের গণতন্ত্রের সাধারণ নিয়মগুলি মানিবার যথেষ্ট ইচ্ছা বা আগ্রহ নাই।
নির্বাচন কমিশনকে ইহাও মানিতে হইবে যে, গণতন্ত্রে কিন্তু বিরোধী দলগুলি ফেলনা নহে। সরকারি বক্তব্যই একমাত্র বক্তব্য নহে। তাই, বিরোধীরা যে অভিযোগ তুলিতেছে, সেগুলিকে সম্মান দিয়া শুনিতে হইবে, এবং তাহার যাথার্থ্য নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করিতে হইবে। কেহ কেহ অভিযোগ তুলিতেছেন কমিশনের পিছনে বহুবিধ ‘চাপ’ বিষয়ে। কিন্তু চাপ যাহারা দিবার তাহারা দিবেই। তাহার মধ্যেই নিরপেক্ষ বিচারের কাজটি করিতে হইবে, ইহাই প্রত্যাশিত। নতুবা আর আলাদা নির্বাচন কমিশনের প্রয়োজন কী, কোনও একটি সরকারি দফতর দিয়াই তো কাজ চালাইয়া দেওয়া যাইত! বিরোধীরা কতখানি নিরপেক্ষতার অবকাশ পাইতেছে, কোনও প্রশাসনিক কমিশনের দক্ষতার মানদণ্ড কিন্তু সেইটিই। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার অমরেন্দ্রকুমার সিংহ অতঃপর এই মৌলিক মানদণ্ডটি মাথায় রাখিয়া কাজ করিবেন কি না, নাগরিকরা তাহা দেখিতে চাহিবেন।