বাল্যবিবাহের পক্ষে সওয়াল করেছেন মধ্যপ্রদেশের বিজেপি বিধায়ক গোপাল পারমার। ছবি: সংগৃহীত।
এ ভাবে সভ্যতার উল্টো দিকে ছোটা যায়! আর কোনও জাতি কী এমনটা পেরেছে এ পৃথিবীতে? প্রশ্ন জাগে।
সে কত দিন আগে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে একটা বৈপ্লবিক চরিত্রকে আমরা পেয়েছিলাম। বিবাহ নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানটির যে ভয়াবহ অপব্যবহার চলত সে সময় ভারতে, তার বিরুদ্ধে সিংহবিক্রমে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন একা। পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া যে সব সিদ্ধান্ত সামাজিক ব্যাধির রূপ নিয়েছিল, একা লড়ে সে সবের অবসান ঘটিয়ে দিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর।
নিজের সমসাময়িক সমাজে বিপুল বাধা এবং প্রবল আক্রমণের শিকার বিদ্যাসাগরকে হতে হয়েছিল, সে সকলেরই জানা। কিন্তু বিদ্যাসাগরের মত যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, সে-ও কারও অজানা নয়। সমাজ যত এগিয়েছে, বিদ্যাসাগর তত বেশি করে পূজিত হয়েছেন। আজ একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেও তিনি পূজিতই হন। কিন্তু পূজার আড়ালে তাঁর সেই লড়াইয়ের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে হাঁটতে থাকি যেন আমরা।
নারীর স্বাধীনতা, নারীর সম্ভ্রমের প্রতি আমরা কতটা সংবেদনশীল, সে প্রশ্ন তো আগেই উঠতে শুরু করেছে। এ বারে আশ্চর্য হয়ে দেখতে হচ্ছে যে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও বাল্যবিবাহের পক্ষে সওয়াল করছেন।
মধ্যপ্রদেশের এক বিজেপি বিধায়ক বাল্যবিবাহের পক্ষে জোরদার সওয়ালটা করেছেন। বিজেপি তথা সঙ্ঘ শিবির যে ‘লভ জেহাদ’ তত্ত্ব নিয়ে সম্প্রতি সরব, তার সূত্র ধরেই বাল্যবিবাহের পক্ষে যুক্তি খুঁজেছেন বিধায়ক গোপাল পারমার। ধর্মান্তরিত করার জন্যই হিন্দু মেয়েদের প্রেমের ‘ফাঁদে’ ফেলছেন মুসলিম ছেলেরা— গোপাল পারমারের মত এমনই। এই ‘লভ জেহাদ’ রোখার জন্য বাল্যবিবাহের নিদান দিয়েছেন তিনি। আঠারো বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত মেয়ের বিয়ে না দিলে স্কুলে-কলেজে তারা তথাকথিত জেহাদের খপ্পরে পড়বে বলে গোপালের মত। তাই আঠারোর অনেক আগেই হিন্দু মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করলেন গোপাল।
গোপাল পারমার যে দলের বিধায়ক, মধ্যপ্রদেশের মসনদ সেই দলের দখলে। দেশের মসনদও সেই দলেরই হস্তগত। দেশের সরকার বাল্যবিবাহের বিপক্ষে জোরদার প্রচার চালাচ্ছে, ‘বেটি বচাও বেটি পঢ়াও’ কর্মসূচি নিয়ে জোর কদমে এগোচ্ছে। কিন্তু বিজেপি-র ঘরটাই কতটা অগোছালো, দেখিয়ে দিলেন গোপাল পারমার।
ঘর শুধু বিজেপি-র অগোছালো, এ কথা ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। ঘর আমাদের গোটা জাতিরই অগোছালো। না হলে এই একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে দেশের সরকারকে ‘বেটি বচাও বেটি পঢ়াও’ স্লোগান দিতে হবে কেন? মেয়েদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে বা মেয়েদের শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে— এটা তো প্রচার চালিয়ে বলার বিষয় নয়। এ তো পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়া যে কোনও মানুষের সাধারণ বোধের বিষয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সে বোধ আমাদের অনেকের মধ্যেই এখনও জাগেনি। তাই সরকার অক্লান্ত পরিশ্রমে সেই বোধ জাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে, জনপ্রতিনিধি বলছেন, বাল্যবিবাহই জরুরি। কী সাংঘাতিক বৈপরীত্য নিয়ে আমরা পথ চলছি, এর পরে আর তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
আবার বলি, বৈপরীত্য, সামাজিক অন্ধকার, নিদারুণ অশিক্ষা রয়েছে বলেই একবিংশ শতাব্দীতে পৌছেও ‘বেটি বচাও বেটি পঢ়াও’ স্লোগান দিতে হয়। যে দেশে, যে সমাজে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো একটা চরিত্র প্রায় দুশো বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিল, সেই দেশ, সেই সমাজ ২০১৮ সালে পৌঁছেও নারী-পুরুষ সমানাধিকার সুনিশ্চিত করতে পারেনি, এ বড়ই অগৌরবের বিষয়। অগৌরবের কারণটা সামাজিক মানসিকতাতেই নিহিত। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে গোপাল পারমারের যা বলার কথা ছিল, তিনি ঠিক তাঁর উল্টোটাই বলেছেন। এতেই সামাজিক পরিস্থিতিটার আভাস পাওয়া যায়। জনপ্রতিনিধিও সেই পরিস্থিতির বাইরে আসতে পারেননি, উত্তীর্ণ মূল্যবোধে পৌঁছতে পারেননি। তাই সাংঘাতিক অসংবেদনশীল মন্তব্য করে বসেন।
সংশোধনটা শিকড় থেকে জরুরি। যদি না পারি, কন্যাসন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার স্লোগান আগামী কয়েকশো বছর ধরেও দিতে হতে পারে পরবর্তী প্রজন্মের সংবেদনশীল অংশকে।