Holi Celebration

রবীন্দ্রভারতীর বসন্তরোগ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গেল কি?

অন্ধকার যে ক্রমশ বাড়ছে, তারই প্রমাণ আবারও মিলল রবীন্দ্রনামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানে দাঁড়িয়ে পড়ুয়াদের একাংশের কাজে। মানসিক বিকৃতির অনেক কিছুকেই এখন আধুনিকতার মোড়ক দেওয়ার রুচিহীন খেলা চলেছে।

Advertisement

অমিতকুমার দে

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২০ ০২:২৭
Share:

রবীন্দ্রস্পর্শ ছড়িয়ে আছে বসন্তহাওয়ায়। কবির প্রিয় ঋতু তাঁর নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়ে শুদ্ধ-স্নিগ্ধ রুচিতে আলোকিত হবে, তেমনই তো কাম্য ছিল। কিন্তু বসন্তোৎসবে শামিল পড়ুয়াদের পিঠে- বুকে অশ্লীল বসন্তরোগ আমাদের আসলে এক ভয়ানক ক্ষতদাগের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। আসলে এই সময়ে প্রত্যেকেই সংস্কৃতির তীব্র অবনমনের আতঙ্কে প্রহর গুনি প্রতিদিন।

Advertisement

মানসিক বিকৃতির অনেক কিছুকেই এখন আধুনিকতার মোড়ক দেওয়ার রুচিহীন খেলা চলেছে। পরিকল্পিত এবং কখনও কখনও বাণিজ্যিকও। কখনও আবার সামাজিক মাধ্যমে তুমুল জনপ্রিয়তার লোভে।

আমরাও অনেকগুলো বসন্ত পেরিয়ে এলাম তো। বসন্ত-উৎসবও তো অনেক দেখলাম, অংশ নিলাম। সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দেওয়ার সময় হাতে পলাশ নিলেই মনটা কেমন করে উঠত! হাল-আমলের জনপ্রিয় গান উদ্ধৃত করেই বলা যেতে পারে— মনে হত ‘বসন্ত এসে গেছে’! রবীন্দ্রভারতীর মেয়েরা বাসন্তী শাড়িই পরেছিলেন। আমাদের অনেকের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতির মেয়েরা অমন শাড়ি পরেই আমাদের তরুণবেলা যৌবনদিন উজ্জ্বল করে বসন্তের দিকে টেনে নিতেন। তাঁরা গাইতেন-নাচতেন— ‘ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে/ডালে ডালে ফুলে ফুলে পাতায় পাতায় রে/আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে’! কিংবা ‘বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা/বইল প্রাণে দখিন-হাওয়া আগুন-জ্বালা’!

Advertisement

আর এখন মনে হচ্ছে, এই বসন্ত এ কোন পরাজয়ের মালা গাঁথল! কেন এ ভাবে এত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে আমাদের তারুণ্য? ধিক্কারের ভয়ে খানিক ক্ষমা চাইলেও অন্তর কি সত্যিই ক্ষমা চাইছে?

লাইক শেয়ারের লোভে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে, রবীন্দ্রকবিতাকে চরম বিকৃত করে ‘পপুলার’ হয়ে উঠছেন কেউ কেউ। আমরা মজা দেখছি। যেন যা খুশি সব করার খোলামেলা পাসপোর্ট আমাদের হাতে। গানের নামে ভয়ানক বেসুরো, কবিতার নামে যাচ্ছেতাই, নৃত্যের নামে অশ্লীলতা— যেন সব আমাদের ন্যায্য অধিকার! যিনি প্রতিবাদ করবেন, তিনি ‘ব্যাকডেটেড’, ‘অর্থোডক্স’! এক সময় জনপ্রিয়তা সুস্থতা দিয়ে, সৌন্দর্য দিয়ে জয় করতে হত। তার জন্য নিজেকে দিনের পর দিন তৈরি করতে হত। সাধনা, রেওয়াজ এই শব্দগুলো কত জরুরি ছিল। আর এখন অল্প কিছু করেই ‘ভাইরাল’ হওয়ার মাত্রাতিরিক্ত তাগিদ! ‘ভাইরাল’ করে তোলার নেশাই এ সময়ের সবচেয়ে বড় ভাইরাস!

বাইরের জৌলুস ভেতরের রং আর সৌন্দর্যকে নষ্ট করে দিচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে নিজের কৃষ্টিকে, কৃষ্টির ধারকদের সম্মান করার শিক্ষা। নিমেষে ছবি তুলে বা ভিডিও করে অনলাইন বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার তুমুল দৌড় শুরু হয়েছে। তাই সামান্যকে অসামান্য করে পরিবেশন করার কৌশল অনেকেই আয়ত্ত করে ফেলেছেন। সোশ্যাল মিডিয়া আর বাজারের অনেকটা দখল করেও ফেলেছেন। এক সময় একটা ভাল ক্যামেরা ছিল স্বপ্ন। আর এখন উন্নত ক্যামেরাযুক্ত মুঠোফোন, ডিএসএলআর হাতে হাতে। যা খুশি তুলে ফেললেই হল। প্রচার তো হাতের মুঠোয়। হালকা রুচির এই হালফিলে দর্শকেরও অভাব নেই, হাততালির খামতি নেই। আর সত্যিকারের সৃজনজগতের মানুষ কোণঠাসা হতে হতে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন ক্রমাগত। আমাদের বাংলা সংস্কৃতি চুরমার করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলেছে। নতুন প্রজন্ম বুঝতে না পেরে নিজেদের সেই নোংরা খেলায় সাবলিল ভাবে জড়িয়ে ফেলছে।

এখনকার কলেজ সোশ্যাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক অনুষ্ঠান, এমনকি সরস্বতী পুজোর অনুষ্ঠানে যা চলছে, মাঝে মাঝে মনে হয়, এ কোন অধঃপতনের সিঁড়ি ভাঙছে আমাদের উত্তরপ্রজন্ম? কোনও কোনও শহরে কয়েকবছর ধরে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের অনুষ্ঠান দেখছি। ‘বর্ষবরণ’, ‘বর্ষবিদায়’ ইত্যাদি শব্দ অবশ্য এখন বাতিলপ্রায়! এ সবের নামকরণ হয়েছে ‘কার্নিভাল’। আর অল্প শব্দে কেউ খুশি নয়। ঢাউস ঢাউস সাউন্ডবক্স, সেখানে শব্দমাত্রা বাঁধা নেই, শান্তিতে বসে গান শোনা দুষ্কর! হৃৎপিণ্ড কাঁপে, মস্তিষ্ক জর্জরিত, চূড়ান্ত অসুস্থ হয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা! উৎসব মানেই তীব্র শব্দের গানের সঙ্গে উদ্দাম নাচ! সবাই নৃত্যশিল্পী! অথচ নিষ্ঠা নিয়ে গান বা নাচ শেখায় তাদের প্রবল অনীহা। আর নেশার চরম বাড়াবাড়ি। মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর বাইরে নেশার বিপুল তরঙ্গ! উৎসব আর উল্লাস বাড়ছে, সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নেশাদ্রব্যের বিপণনও!

কবিতা নিয়েও উদ্ভট কাণ্ডকারখানা চলছে। কবির সংখ্যা পাঠকের চেয়ে ঢের গুণ বেশি। কবিতা লেখা হোক যত খুশি, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু আগাছার সংখ্যা এত বেশি যে, আসল চেনা কঠিন! হাতে টাকাকড়িও এখন যথেষ্ট, সামান্য ক’দিন লিখেই বই ছাপানোয় অসুবিধা নেই। প্রচ্ছদের জৌলুসে তোলপাড় হছে সোশ্যাল মিডিয়া। সঙ্গে জোরদার আত্মপ্রচার।

এই গোলকধাঁধার সময়টায় আমরা ঢুকে পড়েছি। পৌনে পাঁচ থেকে সাড়ে ছ’ইঞ্চির স্ক্রিনে আটকে পড়েছে এই প্রজন্ম, আটকে পড়তে চলেছে ভাবী প্রজন্মও। তাদের জেগে থাকা, খাওয়া, স্বপ্ন, বিনোদন, প্রেম, অপ্রেম, এমনকি ঘুমও এখন হাতের তালুতে রাখা যন্ত্রে। শুধুমাত্র ওদেরই এই অসুখ নয়, ওদের পূর্বসূরিদের সিংহভাগও এই রোগের কবলে।

রবীন্দ্রভারতীতে দাঁড়িয়ে পড়ুয়াদের একাংশ ঝাঁকুনি দিয়ে গেলেন! বাবা-মায়েরাও ঠেকাতে পারছেন না ছেলেমেয়েদের পরিবর্তন। নিম্নরুচির ধারাবাহিকে ডুবে থাকা সাধারণ বাবা-মা কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েকে ভালমন্দ নিয়ে কথা বলতে গেলে কলহ বাধছে। তাঁরা নিজেরাও হতবাক হয়ে যান মাঝে মাঝে, এ কি তাঁদেরই সন্তান! কলেজ ছাড়িয়ে এখন স্কুলস্তরেও উদ্ভট চুলের ছাঁট, কিছু বলা যাবে না। শিক্ষক বলতে গেলে তাঁকে উল্টো সমালোচনায় আক্রান্ত হতে হবে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীনবরণে ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে শান্তশিষ্ট ভদ্র ছেলেটি বা মেয়েটিকে। কাউকে কিছু বলা যাবে না! পচে যাক সব, কিন্তু ভাবতে হবে, আমরা এগোচ্ছি! হু-লাল্লার সঙ্গে রবীন্দ্রগানকে সয়ে নিতে নিতে, গিটারের অকারণ বাড়াবাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রকস্টারদের সেলফি তোলার হিড়িক দেখে যেতে যেতে একদিন হয়তো পুরনোরাও নিজেদের আধুনিক ভাবতে শিখে যাবেন!

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement