শান্তিনিকেতনে চূড়ান্ত পর্বের মহড়া দেখতে এবং মোবাইলে তুলতে মানুষের ভিড়। —নিজস্ব চিত্র
শান্তিনিকেতনে পৌষ উৎসব শেষ হতেই শুরু হয় পাতা ঝরার মরসুম। সব পাতা ঝরে গিয়ে শুধু ডালপালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোকে দেখে সাময়িক কষ্ট হয়। এর পরই কোনও এক বসন্ত সকালে গাছগুলোতে দেখা দেয় কুঁড়ি। সেখান থেকে ফুলে ফুলে ভরে যায় গাছগুলো। উৎসবের জন্য ব্যবসায়ীদের আবির বিক্রি করতে বসার ঢের আগেই শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি আর হরেক রকম ফুলের রং বসন্তোৎসবের জানান দিতে শুরু করে। উৎসবের দিন দুয়েক আগে থেকেই পর্যটকরা আসতে শুরু করেন। শুরু হয় সঙ্গীতভবন যাওয়ার পথের খোঁজ। সকালের অনুষ্ঠানে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে কতটা অনুষ্ঠান দেখতে পারবেন তার কোনও ঠিক নেই। তাই আগে থেকেই ব্যাকুল হয়ে মহড়া দেখেন তাঁরা। কত জন ফিরে যান অতীত স্মৃতিতে। শান্তিনিকেতন এবং শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসবের টান তাঁদের প্রতি বছর টেনে নিয়ে আসে এখানে।
এঁদের মধ্যেই আরও একদল মানুষ আছেন যাঁদের কাছে এই উৎসব নিতান্তই ছুটি কাটানোর জায়গা। আশ্রমের ‘বসন্তোৎসব’ আর পাড়ায় পাড়ায় ‘দোল’ বা ‘হোলি’ খেলা যে কোনওভাবেই সমার্থক নয়, এই ধারণা তাঁদের এখনও নেই। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় মহড়ার ছবি আপলোড করে তাঁরা লেখেন ‘শান্তিনিকেতনে হোলি ফেস্টিভ্যালের রিহার্সাল’। এঁরাই হচ্ছেন সেই সমস্ত মানুষ যাঁরা বসন্তোৎসবের সকালে মঞ্চের অনুষ্ঠানে ‘‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার...’’ গান শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই পিছনে ‘হোলি হ্যায়’ বলে আবির ওড়াতে থাকেন। যদিও এটা না করার জন্য বারবার ঘোষণা করা হয়। তাঁরা হয়তো ভুলে যান, এমন একটা জায়গায় বসন্তোৎসব দেখতে এবং উপভোগ করতে তাঁরা এসেছেন, যেখানে বিদেশি-বিদেশিনিরাও ‘শুভ বসন্তোৎসব’ বলে আবিরে রাঙিয়ে দেন অন্যদের।
বসন্তোৎসবের সকালে হলুদ শাড়ি পরার রীতি রয়েছে শান্তিনিকেতনে। বিশ্বভারতীর একাংশের আক্ষেপ, ইদানীং কিছু পর্যটককে এমন পোশাকে দেখতে পাওয়া যায়, যা বসন্তোৎসবের মননের সঙ্গে বেমানান। এ কথা ঠিক যে অনেকেই শাড়ি সামলাতে পারেন না কিংবা হলুদ শাড়ি হয়তো সঙ্গে আনেননি। তার পরিবর্তে অন্য রংয়ের শাড়ি কিংবা চুড়িদার পরা যেতেই পারে। একই সঙ্গে রঙিন উইগ কিংবা মুখোশও শান্তিনিকেতনী সংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান। শান্তিনিকেতন তো দিল্লি কিংবা মুম্বই নয়। তাই একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, এখানে ‘‘ইতনা মজা কিঁউ আ রাহা হে...’’ গানের সঙ্গে কোমর দোলে না, বরং সেই ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল...’’ গানের সঙ্গে মন দুলে ওঠে। সকালের অনুষ্ঠান শেষে কিছুক্ষণ আবির খেলে নিয়েই পড়ুয়ারা তাঁদের অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের বাড়ি গিয়ে তাঁদের পায়ে আবির ছুঁয়ে আসেন। ছেলেমেয়েরা আসবে জেনে মিষ্টিমুখের আয়োজনে কোনও খামতি রাখেন না তাঁরা। এই হল শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব। যেখানে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বদাই চেষ্টা ছিল বাইরের কোনও উত্তেজনা যেন আশ্রমে না থাকে। আশ্রমের একটা নিজস্ব জীবনধারা তৈরি হয়ে উঠবে এটাই ছিল তাঁর ইচ্ছা। সেই জন্য তিনি আশ্রম বালকদের উপযোগী নাটক রচনা করেছেন। উৎসব অনুষ্ঠানের প্রবর্তন করেছেন। বাইরের উত্তেজনা থেকে তাদের রক্ষা করতে চেয়েছেন বরাবর। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তাঁর চিন্তা স্বদেশের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বের দিকে অভিমুখী হল।
১৯১৬-১৭ সালে কবিগুরু আমেরিকা ভ্রমণে গিয়ে সানফ্রান্সিস্কো থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে লিখলেন, ‘‘শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগসূত্র করে তুলতে হবে। ঐখানে সর্বজাতির মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্র স্থাপন করে তুলতে হবে। স্বজাতিক সংকীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসছে, ভবিষ্যতের জন্য যে বিশ্বজাগতিক মহামিলন যজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে। ঐ জায়গাটিকে সমস্ত জাতিগত ভূগোল বৃত্তান্তের অতীত করে তুলতে হবে, এই আমার মনে আছে, সর্ব মানবের প্রথম জয়ধ্বজা ঐখানে রোপণ হবে। পৃথিবী থেকে স্বাদেশিক অভিমানের নাগপাশ বন্ধন ছিন্ন করাই আমার শেষ বয়সের কাজ।’’
চিঠির কথা থেকেই বোঝা যায়, শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে তিনি সর্বজাতির জন্য গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯২১ সালে বিশ্বভারতীকে সর্বসাধারণের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
কবিগুরুর আমন্ত্রণে কিংবা স্বেচ্ছায় পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে শান্তিনিকেতনে এসেছেন অনেকে। কর্মধারার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বসন্তোৎসবেরও অন্যতম লক্ষ্য ছিল বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানব প্রকৃতির মেলবন্ধন। ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হওয়া শান্তিনিকেতন বসন্তোৎসবের ইতিহাসে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, শান্তিদেব ঘোষের নাম জড়িয়ে আছে। ক্ষিতিমোহন সেনের লেখা থেকে জানা যায় ১৯২৪ সালের ২১ মার্চের বসন্তোৎসবের কথা। ওইদিনই কবিগুরুকে চিনের উদ্দেশে রওনা দিতে হয়েছিল। ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর ‘‘রবীন্দ্রনাথের বসন্ত পূর্ণিমা’’ প্রবন্ধে লিখছেন, ‘‘কবির মুখে হাস্যভরা কথাবার্তা শোনা গেলেও মনে হইল তাঁহার হৃদয় আজ ভারাক্রান্ত। মানবকল্যাণের উদ্দেশে নানা দেশে তাঁহাকে অনেক ঘুরিতে হইয়াছে। কিন্তু এমন দিনে কি কখনও তিনি বাঙলা দেশ ছাড়িয়া যাত্রা করিয়াছেন?’’
সে দিনের সেই বসন্তোৎসবে যোগদানকারীর সংখ্যা শতাধিক থেকে বেড়ে লক্ষাধিক হয়েছে। গৌরপ্রাঙ্গণ থেকে স্থানান্তরিত হয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই উৎসব হচ্ছে আশ্রমমাঠে। দিন যত এগিয়েছে, পরিধি হয়েছে বড়। আশ্রম থেকে এলাকা, এলাকা ছাড়িয়ে রাজ্য, রাজ্য ছাড়িয়ে দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে শান্তিনিকেতন বসন্তোৎসবের ব্যপ্তি। পলাশ, শিমুল, অশোক, বকুল, পারুল চলে গিয়েছে সংখ্যালঘুর দলে। গাছগুলির সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষায় পলাশ নিধনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিশ্বভারতী।
বিশৃঙ্খলা রুখতে কঠোর হয়েছেন কর্তৃপক্ষ। তাঁদের প্রত্যাশা, রবীন্দ্রমনস্ক মানুষের সমাবেশ ঘটুক শান্তিনিকেতনে। যা সুন্দর, সংযত ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ককে সার্থক করে তুলবে। পর্যটক কিংবা স্থানীয় কারওরই এ কথা ভুললে চলবে না যে, যেখানে আজ তাঁরা বসন্তোৎসবে মেতে উঠছেন, একদিন পরে সেখানেই পাঠভবনের পড়ুয়ারা ক্লাস করবে। বিশ্বভারতী শুধুমাত্র বসন্তোৎসব আয়োজক কোনও প্রতিষ্ঠান নয়, এটা বিশ্ববিদ্যালয়, এটা ‘আশ্রম’।