ছবি: সংগৃহীত
অষ্টাদশ শতকের প্রায় প্রথম দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে মুর্শিদাবাদের গৌরব ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র দেশ ও দেশের বাইরে। শাসকের সহায়তায় সেই সময়ের রাজধানী মুর্শিদাবাদ পরিণত হয়েছিল শিল্প, চিত্রকলা, সঙ্গীত ও সাহিত্যের অন্যতম পীঠস্থানে। অথচ সেই রাজধানী নগরীর পূর্ব গৌরব আজ ধুলোয় লুণ্ঠিত। এখন মুর্শিদাবাদের কথা মাথায় এলেই জেলার বাইরের অধিকাংশ মানুষের মানসপটে প্রথমেই ভেসে ওঠে গণ্ডগ্রামের কথা, ভিড়ে ঠাসা লালগোলা ট্রেনের কথা। অথচ মুর্শিদাবাদের আনাচে-কানাচে পূর্বের সেই সোনালী অতীতের কিছু নিদর্শন আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সেগুলির অন্যতম মুর্শিদাবাদের কিছু বিখ্যাত মিষ্টি। চলুন তবে সেই সব জনপ্রিয় মিষ্টান্নের খোঁজে যাওয়া যাক।
সুবে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদ শহরে। সেই শহরের বিখ্যাত মিষ্টি ছানাবড়া। ঠিক কবে এই মিষ্টির উদ্ভব ঘটে সে সম্পর্কে তেমন কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া না গেলেও অনুমান করা হয় ছানাবড়ার উদ্ভব হয়েছিল নবাবি আমলেই। কথিত রয়েছে, নবাবি আমলের প্রায় শেষের দিকে মুর্শিদাবাদ শহরে নিমাই মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি শহরের বুকে একটি মিষ্টান্নের দোকান দিয়েছিলেন। সেই দোকানের ছানাবড়া নাকি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। কথিত রয়েছে, সেই দোকান থেকে ছানাবড়া নিয়মিত নবাব প্রাসাদে সরবরাহ করা হত। নবাবদের ছানাবড়া প্রীতির গল্প কতখানি সত্য তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও মুর্শিদাবাদের নিজামত পরিবারে যে মাঝে মাঝেই ছানাবড়ার প্রবেশ ঘটত, তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। মুর্শিদাবাদে ছানাবড়ার তৈরির দু’জন বিখ্যাত কারিগর ছিলেন সৈদাবাদের পটল সাহা ও গোপেশ্বর সাহা। পটল সাহা অবশ্য পটল ওস্তাদ নামেই খ্যাত ছিলেন। তাঁর হাতের ছানাবড়া সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকি রাজারাও মুগ্ধ হতেন। কথিত রয়েছে কাশিমবাজারের রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী ছানাবড়ার খুব সমঝদার ছিলেন। এবং তাঁর হাত ধরেই ছানাবড়ার সুনাম মুর্শিদাবাদের গণ্ডী পেরিয়ে বহু দুর অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল।
আজ মুর্শিদাবাদের প্রায় সর্বত্রই ছানাবড়া পাওয়া যায়। কিন্ত ছানাবড়ার উদ্ভব যে শহরে হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়, সেই মুর্শিদাবাদ শহরেই আজ ছানাবড়ার তেমন কোনও ভাল দোকান নেই। পুরানো ঐতিহ্যবাহী যে সব দোকানগুলি ছিল সেগুলি আজ বন্ধ। বর্তমানে মুর্শিদাবাদের ছানাবড়া বললে বহরমপুরের ছানাবড়াকেই সাধারণত বোঝানো হয়। বহরমপুরের খাগড়ার ছানাবড়া আজও সমান জনপ্রিয়। খাগড়া ছাড়াও শহরের বেশ কিছু এলাকায় ভাল মানের ছানাবড়া এখনও পাওয়া যায়।
ছানাবড়া তৈরিতে প্রথমেই প্রয়োজন উৎকৃষ্ট মানের টাটকা ছানা। ছানাকে ভাল করে বেটে নিয়ে তাকে গোল আকার দেওয়া হয়। তারপর এতে সুগন্ধি আনতে এলাচ দানা কিংবা এলাচগুঁড়ো মেশানো হয়। তারপর ছানার বলগুলি ফুটন্ত দেশি ঘিয়ে ভাজার জন্য ছাড়া হয়। বেশ কিছু ক্ষণ ভাজার পরে বলগুলিতে লালচে রং ধারলে সেগুলি কড়ায় থেকে তুলে চিনির রসে ফেলতে হয়। বেশ কয়েক ঘণ্টা রসসিক্ত হলে তবেই তা খাওয়ার উপযুক্ত হয়।
এ বারে মুর্শিদাবাদ তথা বহরমপুরের আরও একটি মিষ্টির কথা বলব আপনাদের। এই মিষ্টি শুধু বহরমপুরেই নয় বরং বাংলার প্রায় বিভিন্ন প্রান্তেই পাওয়া যায়। মিষ্টির নাম লেডিকেনি বা লেডিকেন। অবশ্য এই মিষ্টির উদ্ভাবক এর নামকরণ করেছিলেন ভারতের গভর্নর জেনারেল চার্লস ক্যানিং-এর পত্নী শার্লট ক্যানিং-এর নাম অনুসারে। কিন্ত কে এই নামকরণ করলেন? কেনই বা করলেন, তা নিয়ে বহু মতামত রয়েছে। অধিকাংশ মত অনুযায়ী উনিশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে এই মিষ্টি প্রথম কলকাতায় তৈরি হয়েছিল। কথিত রয়েছে কলকাতার ভীমচন্দ্র নাগ নামে এক মোদক নাকি এই মিষ্টির উদ্ভাবক। তিনি লেডি ক্যানিং-এর জন্মদিনে তাঁর সম্মানার্থে এই মিষ্টি তৈরি করে তাঁকে উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। এই মিষ্টি খেয়ে লেডি ক্যানিং নাকি খুব প্রসন্নও হয়েছিলেন। তাই তখন থেকেই এই মিষ্টির নামকরণ হয় লেডি ক্যানিং-এর নামে। আপনাদের এ বার হয়ত মনে হচ্ছে এই মিষ্টি তো তবে কলকাতার। এর সঙ্গে মুর্শিদাবাদের সম্পর্ক কী? তবে জেনে রাখুন, এই লেডিকেনি বা লেডিকেন মিষ্টির উদ্ভবের আরও একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে।
তখন বহরমপুরে সবে সিপাহি বিদ্রোহ শেষ হয়েছে। এমন সময় গভর্নর জেনারেল চার্লস ক্যানিং তাঁর পত্নীকে নিয়ে কোনও এক কাজে বহরমপুরে এলে বহরমপুরের জনৈক ময়রা লেডি ক্যানিংকে খুশি করতে এক ধরনের মিষ্টি প্রস্তুত করে তাঁর কাছে উপহার স্বরূপ পাঠান। তিনি তা খেয়ে খুব খুশি হন। সেই থেকেই এই মিষ্টির নামকরণ করা হয় লেডি ক্যানিং বা লেডিকেনি। তাই শুধু কলকাতাতেই নয়, আমাদের জেলাতেও লেডিকেনির খুব কদর ছিল দীর্ঘ দিন ধরে।
এই মিষ্টি তৈরির প্রধান উপকরণ হিসেবে লাগত খোয়া ক্ষীর ও ছানা। সঙ্গে সুগন্ধি আনতে ব্যবহার করা হত এলাচ। দেশি ঘিয়ে ভেজে পাতলা চিনির রসে ডুবিয়ে প্রস্তুত হত এই লেডি ক্যানিং, লেডিকেন বা লেডিকেনি। বর্তমানে এই মিষ্টি জেলার খুব অল্প সংখ্যক দোকানেই পাওয়া যায়। জেলার সদর শহর বহরমপুরের হাতে গোনা কয়েকটি দোকানে এই মিষ্টি পাওয়া যায়। তবে লেডি ক্যানিং মিষ্টির সাথে পান্তুয়া এবং গোলাপজামুনের পার্থক্য তেমন না থাকায় অনেক সাধারণ মানুষই লেডিকেনিকে আলাদা মিষ্টি বলে চিনতে ব্যর্থ হন। অনেক দোকানে তো আবার পান্তুয়া কিংবা গোলাপজামুনকেই লেডিকেন বলে চালিয়ে দেয়। ফলে লেডিকেনের জন্য সতর্ক হতে হবে। তবেই পাবেন সেই ঐতিহ্যবাহী লেডি ক্যানিং বা লেডিকেনের স্বাদ।