প্রণত: রামলালার মূর্তির সামনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অযোধ্যা, ৫ অগস্ট। ছবি: পিটিআই
মন্দির তো হল, এ বার আর্থিক উন্নয়নের দিকে মন দিক সরকার— গত কয়েক দিনে খবরের কাগজের পাতায় প্রকাশিত অন্তত দু’টি নিবন্ধে, এবং বহু মানুষের ফেসবুক ওয়ালে এই কথাটা দেখলাম। আর কী-বা বলতে পারতেন তাঁরা? এইটুকু আশা করা ছাড়া যে, যা হয়েছে, হয়েছে— এ বার বন্ধ হোক এই অসহনীয় বর্বরতা, ধর্মের রাজনীতি ছেড়ে দেশ উন্নয়নে মন দিক?
এক ভাবে দেখলে, উন্নয়নের দিকে নজর ফেরানোর এই আর্তির মধ্যে কোথাও একটা নেহরু-যুগের ক্ষীণ প্রতিফলনের খোঁজ পাওয়া সম্ভব— জাতি-ধর্ম-ভাষাগত বিভেদ ভুলে উন্নয়নের সূত্রেই ভারতের পরিচিতি তৈরি করতে হবে, এ রকমই তো ভেবেছিলেন তাঁরা। ভেবেছিলেন দেশভাগ নামক এক সুগভীর বিষাদের থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে, ভেবেছিলেন ধর্মের নামে বাটোয়ারা হওয়া দেশের জন্য সর্বজনীন শুশ্রূষার উপায় হিসেবে।
তা হলে কি সেটাই ঠিক হবে— আমরা জাতিগত ভাবে বিস্মৃত হব সংবিধানের প্রতি এই বিশ্বাসঘাতকতার কথা? ভাবব, যা হওয়ার হয়েছে, এর পর উন্নয়নের মলমে প্রলেপ পড়বে সেই গভীর ক্ষতের ওপর? সেটা হলে কী রকম হবে, সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটা কথা মনে করে নেওয়া ভাল— ২০১২ সাল নাগাদ দেশের বহু মানুষ বলেছিলেন, দশ বছর আগে গুজরাতে কী হয়েছিল, সে কথা মনে না রেখে বরং তাকানো যাক ভবিষ্যতের দিকে। দেশ ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েছিল। সেই ভবিষ্যতেই ঘটেছে একের পর এক গো-সন্ত্রাসের ঘটনা, সংঘটিত হয়েছে দিল্লির দাঙ্গা, সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে উড়িয়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে এমন আইন, যাতে প্রশ্নের মুখে পড়ে মুসলমানদের নাগরিকত্ব।
নাগরিকরা অতীত ভুলে ভবিষ্যতের দিকে তাকালে সুবিধা শাসকের। গণতন্ত্রের প্রতি নিজেদের অনাস্থা যত স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দিন না কেন নরেন্দ্র মোদীরা, মানুষের চোখে বৈধতার গুরুত্ব তাঁদের কাছেও যথেষ্ট। শাসক হিসেবে বৈধতা, নেতৃত্বের বৈধতা। অতীতের এই দগদগে ক্ষতচিহ্ন সেই বৈধতা অর্জনের পথে মস্ত বাধা। ২০০২ সালের গুজরাতের কথা গণস্মৃতি থেকে মোছার জন্য গুজরাত মডেলকে সর্বশক্তিতে বিপণন করেছিলেন মোদীরা। তবে, তার জন্য অন্তত তাঁদের তরফেই আগে উদ্যোগ করতে হয়েছিল। এ বার যদি উগ্র হিন্দুত্ববাদে অদীক্ষিত নাগরিক স্বেচ্ছায় রামমন্দিরের মর্মান্তিক স্মৃতি ভুলতে চায়, নাগরিক সমাজ যদি নিজে থেকেই উন্নয়নের গাজর ঝুলিয়ে নিতে চায় চোখের সামনে, তা হলে নেতাদের জনসংযোগ সংস্থা আর বিজ্ঞাপনী প্রচারের পিছনে প্রধানমন্ত্রীর খরচ কমবে হয়তো।
কিন্তু, গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠানকে সাক্ষী রেখে ধর্মনিরপেক্ষ উদারবাদী ভারতের কফিনে শেষ পেরেকটিও ঠুকে দিলেন প্রধানমন্ত্রী, সত্যিই ভেঙে ফেলা বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দিরের ভিত স্থাপিত হল— এই অবিশ্বাস্য বাস্তব যাঁদের কাছে, ধরে নেওয়া যাক মুষ্টিমেয় মানুষের কাছেই, অসহ ঠেকে, এই স্মৃতিকে না ভুললে তাঁরাই বা এগোবেন কী করে? সত্যিই কি উন্নয়ন, ভাল থাকা, ভুলিয়ে দিতে পারে না অনেক যন্ত্রণাকে? ভারতের অভিজ্ঞতা কিন্তু বলছে, পারে। অন্তত পেরেছিল। উন্নয়নের পরিচয়ের ভারতীয়ত্বের সংজ্ঞা নির্মাণের স্বপ্ন যদি বা আকাশকুসুমও হয়, তবু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভ্রাতৃঘাতী বাটোয়ারার স্মৃতিকে বহুলাংশে সহনীয় করে তুলেছিল স্বাধীন ভারতের উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ। তা হলে কি উচিত হবে না, এই স্মৃতিকেও ভোলার চেষ্টা করা— যদি বা তাতে শাসকদের লাভ হয়, তবুও?
এখানে যে কথাটা বলার, তা নিতান্ত ক্লিশে, কিন্তু কথাটা না বললেই নয়— নেহরুর ভারত আর নরেন্দ্র মোদীর ভারত সম্পূর্ণ আলাদা দুটো দেশ। সর্বার্থেই আলাদা, কিন্তু সবচেয়ে আলাদা দেশের মানুষকে দেখার ভঙ্গিতে। নেহরু জানতেন, খণ্ডিত ভারতে মুসলমানদের রক্ষা করার কর্তব্য সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের; নিজ ভূমে তাঁরা যেন পরবাসী না হয়ে যান, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের মৌলিক কর্তব্য। সর্দার পটেলকে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন নেহরু যে ভারতের প্রতি আনুগত্য প্রমাণের কোনও দায় মুসলমানদের নেই— সেই প্রমাণ চাওয়া তাঁদের অপমান করা বই আর কিছু নয়। নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছেন, ভীতি বিনা প্রীতি হয় না— রামচন্দ্র ধনুক তোলার পরই সমুদ্র নড়ে বসেছিল। অর্থাৎ, ভীতির অস্ত্রেই মুসলমানদের আনুগত্য আদায় করে নেবেন তাঁরা। সেই দেশের প্রতি আনুগত্য, যেখানে ক্রমে তাঁদের নাগরিকত্ব বিপন্ন। নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছেন, সমগ্র ভারতকে এক সূত্রে গাঁথবেন রামচন্দ্র। সেই সূত্রে মুসলমানরা গাঁথা পড়বেন না, প্রধানমন্ত্রী জানেন। তাঁর দেশের ধারণায় মুসলমানদের অস্তিত্ব নেই। নেহরুর কাছে উন্নয়নের মন্ত্রে অতীত ভোলার যে অর্থ ছিল, মোদীর কাছে তা প্রত্যাশা করা বাতুলতা। নেহরুর কাছে, অন্তত ধর্মীয় বিভাজনের প্রশ্নে, উন্নয়ন ছিল সর্বজনীনতার পথ; মোদীর কাছে সেই উন্নয়ন মানে মুসলমানদের আরও বেশি বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া।
কাজেই অতীত ভুলে— ২০০২-এর গণহত্যা ভুলে, দিল্লির দাঙ্গা ভুলে, গো-সন্ত্রাস ভুলে, কাশ্মীর ভুলে, রামমন্দির ভুলে— যদি উন্নয়নের পথে হাঁটার কথা বলি, আসলে বলব, দেশের এক-পঞ্চমাংশ মানুষকে বাদ দিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে রাজি। উন্নয়ন আর রামমন্দির আসলে দুটো আলাদা আখ্যান তো নয়— শাসক কী ভাবে দেশকে দেখেন, দেশের মানুষকে দেখেন, সেই সূত্রই বেঁধে রাখে এই আপাত-বিচ্ছিন্ন, আপাত-বিপ্রতীপ ক্ষেত্রগুলোকে। হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তার উন্নয়ন মুসলমানদের খোঁজ রাখবে না। অবশ্য শুধু মুসলমান নয়, আজ যাঁরা রামমন্দির প্রতিষ্ঠায় আত্মহারা, তাঁদেরও অনেকেই সেই রাষ্ট্রে নিতান্ত অপর হবেন। কখনও জাতের হিসেবে, কখনও ভাষার মাপকাঠিতে, কখনও খাদ্যাভ্যাসের নিরিখে, কখনও গায়ের রঙে। উন্নয়ন কখনও অপরের জন্য নয়।
মন্দিরের স্মৃতি ভুলতে উন্নয়ন চাওয়ার অরাজনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা এখানেই— সেই অরাজনীতির আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা মারাত্মক রাজনীতিটা চোখ এড়িয়ে যায়। সেই ‘উন্নয়ন’, যে আসলে একের পর এক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার খেলা, এই কথাটা ভুলিয়ে দিতে চায়। নাগরিক সেই উন্নয়ন কামনা করলে অতীতের অন্যায় বৈধ হয়, তা তো বটেই— সেই অন্যায়টা এমনই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, এমনই অভ্যাস হয়ে যায় যে, এক সময় তার আর কোনও অভিঘাত থাকে না। সেই স্বাভাবিকতায় নতুন অন্যায়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় মাত্র। কে বলতে পারে, যাঁরা মনেপ্রাণে হিন্দুত্ববাদী নন, তাঁরা যদি ২০০২-এর মার্চকে এত সহজে ভুলে যেতে রাজি না হতেন, রাজধর্ম থেকে সেই প্রবল বিচ্যুতিকে যদি তাঁরা সত্যিই অক্ষমণীয় অপরাধ মনে করতেন, তা হলে হয়তো ২০২০ সালের ৫ অগস্ট তারিখটার কোনও ইতিহাস তৈরি হত না।
উন্নয়নের মলমে এই ক্ষত ঢাকতে সম্মত না হওয়ার মানে কি উন্নয়নের বিরোধিতা করা? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায়, সত্যিই সব বিদ্বেষবিষ ভুল, সরকার সর্বজনীন উন্নয়নের চেষ্টা করবে, তাকেও কি স্বীকার করা ভুল হবে তা হলে? না। রামমন্দিরের স্মৃতি না ভোলার অর্থ বার বার শুধু এই কথাটুকু মনে করিয়ে দেওয়া যে, উন্নয়ন যেমন সরকারের দায়িত্ব, সব নাগরিকের প্রতি সমদর্শী হওয়াও ঠিক একই রকম দায়িত্ব। কোনও একটার ব্যর্থতা অন্য দায়িত্ব পালন করায় ঢাকা পড়ে না। বার বার মনে করিয়ে দেওয়া যে, শাসন করার বৈধতা এই শাসকের নেই।
অবশ্য, অত দূর যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। বিভেদের রাজনীতি সর্বজনীন উন্নয়নের পথে
হাঁটতে পারে না। মন্দিরের ভারত থেকে প্রধানমন্ত্রী যাঁদের বাদ দিলেন, উন্নয়ন থেকেও তাঁরা বাদ পড়ছেন, এটুকু দেখতে পাওয়ার মতো চোখ খোলা রাখলেই চলবে।