গেরুয়াধারী এবং সাদা শাড়ি
Mamata Banerjee

‘রাম রাজ্য’ বলতে কি তবে এমন মনুষ্যত্বহীন প্রশাসন বুঝব

হাথরসে নির্যাতিতার পরিবারকে বাড়িতে আটক করে রেখে পুলিশ কী ভাবে তাঁর দেহটি রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে দিল, আমরা জানি।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২০ ০১:৪৪
Share:

সংগৃহীত চিত্র

উত্তরপ্রদেশের হাথরস গোটা দেশের প্রতিবাদের ভাষাকে একসূত্রে বেঁধে দিয়েছে। বাংলা তার অবিচ্ছেদ্য শরিক। ঘটনাটি শুধুই ধর্ষণ ও খুনের অথবা নির্যাতিতার দলিত পরিচয়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। সব কিছু ছাপিয়ে শাসকের মনুষ্যত্বহীনতা কোন নরকের স্তরে পৌঁছতে পারে, হাথরস-কাণ্ড সেটা দেখিয়েছে।

Advertisement

এই রাজ্যের রাজনীতিতেও ওই ঘটনার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। বিশেষ করে এখানে আগামী বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপি-শাসিত অপর এক রাজ্যের এমন ঘটনাকে নরেন্দ্র মোদীর দলের ‘সুশাসন’-এর পরাকাষ্ঠা হিসেবে তুলে ধরে বেলুন ফুটো করার সুযোগ এখানকার শাসক তৃণমূল ছাড়বে না! সেটা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট।

আইনশৃঙ্খলা বিষয়টি অবশ্য সর্বদাই খুব সংবেদনশীল। যে দল বা যে রঙেরই সরকার হোক, আইনশৃঙ্খলাজনিত কোনও ঘটনা ঘটলে অথবা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে, প্রথমেই শাসকের সচেতন চেষ্টা থাকে তাকে যথাসম্ভব লঘু করে দেখানোর। ভাবখানা হয় যেন, যারা এ সব সামনে তুলে ধরছে তারা মিথ্যাবাদী এবং চক্রান্তকারী। অনেক ক্ষেত্রে সরকার ও শাসককুলের এমন মানসিকতার জন্য ছোট বিষয়ও পাকিয়ে ওঠে। কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে পড়ে। আর বাস্তবিক বড় কোনও বিষয় হলে তো কথাই নেই। সেখানে শুধু রাজনীতির গণ্ডিতে তা থেমে থাকতে পারে না। রীতিমতো সামাজিক আন্দোলনের চেহারা নেয়।

Advertisement

স্মরণকালের মধ্যে এই রাজ্যে তার দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে বানতলা এবং কামদুনিতে ধর্ষণ ও খুনের দু’টি পৃথক ঘটনা। প্রথমটি বামফ্রন্ট আমলের। দ্বিতীয়টি তৃণমূল সরকারের জমানায়। সবাই বুঝতে পারছেন, এ সব আলোচনা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে হাথরসে দলিতকন্যাকে ধর্ষণ ও খুন করার পরিপ্রেক্ষিতে। তবে যাঁরা হাথরসের পাল্টা এই রাজ্যের বিবিধ উদাহরণ তুলে ধরার চেষ্টায় রত, সর্বাগ্রে তাঁদের জন্য কিঞ্চিৎ আলোচনার প্রয়োজন। তাতে হাথরসের সঙ্গে বাকি ঘটনাগুলির তফাত বোঝার সুবিধা হতে পারে। মুড়ি-মিছরি একাকার করে ফেলার ঝুঁকিও তাতে কম!

এই রাজ্যে ধর্ষণ-খুনের যত ঘটনা ঘটেছে, তা গুরুত্বে কম-বেশি যা-ই হোক, কোনও মতেই অভিপ্রেত হতে পারে না। বানতলা, কামদুনি বা পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের অভিঘাত অনেক বেশি ছিল। তাই বার বার সেগুলি ধাক্কা দেয়। কিন্তু তার বাইরে নানা অনভিপ্রেত ঘটনায় ক্ষমতাসীনদের সামাজিক চাপে পড়তে হয়েছে। রাজনীতির কথা তো বাদই দিলাম।

বানতলা-কাণ্ড বছর তিরিশ আগের। স্বাস্থ্য আধিকারিকদের গাড়ি তাড়া করে তাঁদের ধরে মহিলা অফিসারদের উপর কদর্য শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল এক দল গ্রামবাসীর নেতৃত্বে। পরে মৃত্যু হয়েছিল এক নির্যাতিতার এবং তাঁদের গাড়ি চালকের। ঘটনার ভয়াবহতায় শিউরে উঠেছিল সমাজ। প্রতিবাদও ছিল তীব্র।

মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর প্রতিক্রিয়া জানার জন্য পর দিন মহাকরণে তাঁকে একটি প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিলাম। মনে আছে, সে দিন সন্ধেবেলায় নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে চশমার কাচে লেগে থাকা ঠান্ডা হাওয়ার বাষ্প মুছতে মুছতে লিফটের দিকে হাঁটছিলেন জ্যোতিবাবু। এগিয়ে গিয়ে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করতেই নিছক মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে তাঁর প্রথম জবাব ছিল, ‘‘ও রকম তো কতই হয়!’’ লিফট তাঁকে নিয়ে নেমে গেল। আর বাক্যটি আগুন জ্বালিয়ে দিল রাজ্যে। সেই থেকে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে আজও এই কথাগুলি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

প্রায় তুলনীয় ২০১৩ সালে কামদুনিতে এক ছাত্রীকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা। কলেজে পরীক্ষা দিয়ে বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় হেঁটে নিজের গ্রামে ফিরছিলেন তিনি। সমাজের কিছু কীট তখন নেশা করছিল পাশের একটি পরিত্যক্ত কারখানার গেটের সামনে। সেখানেই মেয়েটিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর দেহ মেলে পর দিন জলা জমির ভিতর থেকে। সঙ্গত ভাবেই গ্রামে সংগঠিত বিক্ষোভ তুমুল আকার নেয়।

ঘটনার কয়েক দিন পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে গেলে গ্রামবাসীদের সঙ্গে তাঁর কথা কাটাকাটি হয়। তিনি বিক্ষোভের পিছনে সরাসরি রাজনৈতিক উস্কানির অভিযোগ আনেন। আঙুল তোলেন সংবাদমাধ্যমের একাংশের ভূমিকার দিকেও। পরিস্থিতি তাতে আরও জটিল হয়।

এটা ঠিক যে, বানতলা নিয়ে জ্যোতিবাবুর লঘু মন্তব্য এবং কামদুনিতে মমতার ক্রোধের প্রকাশ—কোনওটিই না-হলে ভাল হত। পার্ক স্ট্রিটের বার থেকে বেরোনো মহিলার সঙ্গে এক দল যুবকের অশ্লীল আচরণের বিষয়টিকেও গোড়াতেই ‘ছোট ঘটনা’ বলা উচিত হয়েছিল বলে মনে করি না। বস্তুত, রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদাধিকারীদের কাছে আরও সংযম, আরও সহনশীলতা আশা করা দোষের কিছু নয়।

তাই ওই সব ঘটনায় দুই মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের নিজ নিজ ধর্ম থেকে সাময়িক ভাবে কিছুটা বিচ্যুত হয়েছিলেন বললে ভুল হবে না। কিন্তু তার জন্য বাংলাকে যোগীবরের হাথরস-কলঙ্কিত ‘রাম রাজ্য’-এর সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে বসানো কত দূর সঙ্গত, সেটাও বিচার্য।

প্রথমেই মনে রাখতে হবে, একশো চল্লিশ কোটির দেশে অপরাধের ঘটনা খুব স্বাভাবিক। কোনও পুলিশ, প্রশাসন বা সমাজরক্ষকের সাধ্য নেই তা রোধ করার। আবার এও ঠিক, এই রকম জঘন্য কিছু ঘটলে তার দায় সরাসরি সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সরকারের উপর বর্তাবেই। মানুষ শাসকদের কাছে জবাবদিহিও চাইবেন। এ হল জনক্ষোভের অনিবার্য বিস্ফোরণ। জ্যোতিবাবু, মমতা, যোগী আদিত্যনাথের মধ্যে সেখানে কোনও ফারাক থাকার কথা নয়।

আসল প্রশ্ন কিন্তু অন্য। সেটা হল, কোনও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটার পরেও পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ও পুলিশ-প্রশাসনের যে ভূমিকা হওয়া উচিত, সেটা ঠিকমতো পালিত হয়েছে কি? সাধারণের দৃষ্টিতে শাসককুল কতটা সদর্থক, বিশ্বাসযোগ্য, সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে পারলেন, এ সব ক্ষেত্রে সেটা খুব বড় ব্যাপার। কোথাও কোনও ফাঁক থাকলে তা-ও তখন নজরে পড়ে যায়।

হাথরসে নির্যাতিতার পরিবারকে বাড়িতে আটক করে রেখে পুলিশ কী ভাবে তাঁর দেহটি রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে দিল, আমরা জানি। জেলাশাসক নামক এক মনুষ্যত্বহীন আইএএস অফিসার মৃতার বাড়িতে গিয়ে কী ভাবে বয়ান বদলের জন্য পরিজনদের হুমকি দিলেন এবং পঁচিশ লক্ষের ক্ষতিপূরণ পকেটে পুরে সব চেপে যেতে তাঁদের প্ররোচিত করলেন, সেটাও এখন প্রকাশ্য। মেয়েটির মৃত্যুকালীন জবানবন্দি থাকা সত্ত্বেও দশ দিন পরের ফরেনসিক রিপোর্টকে পুঁজি করে, কী ভাবে গোটা ঘটনাকে ‘ধর্ষণ-মুক্ত’ করার কাজ চলেছে, তা-ও সবাই দেখেছেন।

আরও একবার বানতলা, কামদুনি ইত্যাদির দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যেতে পারে, হাথরসের ঘটনায় জগতের সামনে নিজ রাজ্যের শাসনব্যবস্থার যে নির্মম মুখচ্ছবি উত্তরপ্রদেশের গেরুয়াধারী শাসক তুলে ধরেছেন, পশ্চিমবঙ্গ অন্তত মানবতার সেই কলঙ্ক থেকে মুক্ত। এই বাস্তবতা অস্বীকার করে কেউ সব এক মানদণ্ডে মাপতে চাইলে সেটা ঠিক নয়, বাস্তব নয়— সেটা হবে অভিসন্ধি।

না, এই রাজ্য এখনও ততটা নরক হয়ে ওঠেনি! কামদুনি, বানতলা বা অনুরূপ কোনও ঘটনার পরে মৃতার পরিবারকে পুলিশ দিয়ে আটকে রেখে পুড়িয়ে দেওয়া হয়নি তাঁর দেহ। কোনও আইএএস, আইপিএস-কে পাঠিয়ে বলা হয়নি, বিপদে পড়তে না চাইলে টাকা নিয়ে চেপে যাও! এখানেও সরকার দুর্ভাগ্যগ্রস্ত পরিবারকে টাকা দেয়, তবে তা চাপ দিয়ে বয়ান বদলের প্ররোচনা দিতে নয়।

তবু রাজনীতি তার নিজের নিয়মে চলবে। হাথরসকে হাতিয়ার করে আগামী নির্বাচনে শাসক তৃণমূল যেমন তাদের গত লোকসভায় হারানো দলিত-জমি ফিরে পাওয়ার জন্য ঝাঁপাবে, তেমনই বিজেপিও মমতার প্রশাসনকে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে পাল্টা কাঠগড়ায় তুলবে।সে সব হারজিতের খেলা চলতে থাক। বিবেকের আয়নায় কিন্তু গেরুয়াধারী এবং সাদা শাড়ির ফারাক ধরা পড়ে গিয়েছে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement