শান্তিপুরের বয়ন শিল্পে হস্তচালিত তাঁতের পাশাপাশি, যন্ত্রচালিত তাঁতও এক বিরাট অংশ দখল করে নিয়েছে।
নদিয়ার শান্তিপুর শহরটি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে শান্তি ও ঐতিহ্যের শহর নামে পরিচিত হলেও বাংলার মানুষের কাছে শহরটির আসল পরিচয় জড়িয়ে আছে শান্তিপুরী শাড়ির সঙ্গে। শান্তিপুরী শাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা তাঁত শিল্প শান্তিপুরের অর্থনীতিরও অন্যতম চাবিকাঠি। শান্তিপুরের শাড়ি, মেধা সম্পত্তি অধিকার সুরক্ষার জন্য ভৌগোলিক চিহ্নের ট্যাগও পেয়েছে। কথিত আছে, ১৪০৯ সালে গৌড়ের রাজা গণেশ দানু সাধনদেবের সময়ে শান্তিপুরে প্রথম শাড়ি বোনার সূচনা হয়। তবে রাজা রুদ্র দেবের সময় থেকে বাণিজ্যিক ভাবে শাড়ি বোনার ঝোঁক বাড়তে থাকে। শান্তিপুরের তাঁত শিল্পের বাড়বাড়ন্ত হয় স্বাধীনতার পরে, যখন বাংলাদেশের তাঁতিরা বা তাঁদের পূর্বপুরুষেরা পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশ থেকে শান্তিপুরে চলে আসে।
এখন শান্তিপুরের বয়ন শিল্পে হস্তচালিত তাঁতের পাশাপাশি, যন্ত্রচালিত তাঁতও এক বিরাট অংশ দখল করে নিয়েছে। ২০১৫ সালে রানাঘাট-ফুলিয়ার তাঁত বয়ন শিল্প কেন্দ্র থেকে প্রথম এই যন্ত্র চালিত তাঁত শান্তিপুরে আসে এবং এখন প্রায় সমগ্র অঞ্চলকে গ্রাস করে ফেলেছে। সমীক্ষায় থেকে দেখা গিয়েছে, প্রায় ৮৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ এখন যন্ত্রচালিত তাঁতের সঙ্গে জড়িত এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে হস্তচালিত তাঁত দিনের পর দিন অবক্ষয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। স্থানীয় তাঁতিরা মনে করেন, আগামী দশ-বারো বছর পরে শান্তিপুরের বয়ন শিল্প কেন্দ্রে হয়ত একটিও হস্তচালিত তাঁত খুঁজে পাওয়া যাবে না। হস্তচালিত তাঁতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহিলা এবং বৃদ্ধ শ্রমিকেরা যুক্ত রয়েছেন। অন্য দিকে, যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ তাঁরা অন্য রাজ্যে গিয়ে কারখানা বা হোটেলের কাজ করছেন। কারণটা সহজবোধ্য। রোজগার এত কম যে তাই দিয়ে সংসার চালানো মুশকিল। পুরুষেরা বাইরে যাচ্ছেন একটু বেশি রোজগারের আশায় আর মহিলা ও বৃদ্ধেরা চালিয়ে যাচ্ছেন অল্প রোজগারের হস্তচালিত তাঁত।
শান্তিপুরের তাঁত বয়ন শিল্পে তিন ধরনের ব্যবস্থা লক্ষ করা গিয়েছে। প্রথমত, স্বাধীন তাঁতি, যাঁরা মহাজন বা তৃতীয় কোন ব্যক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীন ভাবে কাজ করেন। কাঁচামাল আনা থেকে শুরু করে কাপড় বোনা এবং উৎপাদিত দ্রব্য বাজারে বিক্রি করা—সবই নিজেরাই করে থাকেন। শান্তিপুরে এ ধরনের তাঁতির সংখ্যা এক সময়ে প্রচুর হলেও এখন বেশ কম। দ্বিতীয়ত, পরাধীন তাঁতি, যারা খুব গরিব এবং এর জন্য তাঁরা সম্পূর্ণ ভাবে মহাজনের উপর নির্ভর করে থাকেন। শান্তিপুর তাঁত বয়ন কেন্দ্রে এঁদের সংখ্যা সব থেকে বেশি, এঁরাই এই শিল্পের প্রাথমিক কারিগর। প্রাথমিক বিনিয়োগ থেকে শুরু করে কাঁচামাল আনা, উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি— পুরোটাই মহাজন নির্ভর। আর সেই সুযোগে মহাজনেরা তাঁদের ইচ্ছেমতো গরিব তাঁতিদের ব্যবহার ও শোষণ করে থাকেন। তৃতীয় গোত্রের তাঁতিরা সংখ্যায় বেশ কম হলেও তাঁদের অবস্থাই তুলনামূলক ভাবে ভাল। এঁরা কোনও একটি নির্দিষ্ট সমবায়ের অধীন কাজ করেন এবং ওই সমবায় তাঁদের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে থাকে। এঁদের জীবন যাত্রার মান বাকি দুই শ্রেণীর তুলনায় বেশ উন্নত।
এই তিন ধরনের তাঁতিরাই মূলত শান্তিপুর বয়ন কেন্দ্রের মূল কারিগর। এ ছাড়াও আছে বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক, সুতো-কারিগর, নকশা-কারিগর ইত্যাদি। বয়ন শিল্পের সবচেয়ে বেশি শ্রমিক সুতো কারিগর হিসেবেই নিয়োগ হয় এবং এঁরা হলেন সেই গরিব মানুষ যাদের হস্তচালিত বা যন্ত্রচালিত তাঁত কোনটা কেনার ক্ষমতা নেই তাই বাধ্য হয়ে সুতোর কাজ করেন। অন্য দিকে, নকশা কারিগরেরা সাধারণত নিজের সৃজনশীলতা এবং কল্পনা দ্বারা পুরো কাজটির নকশা বা প্রতিচিত্র তৈরি করে। দক্ষতা ও জ্ঞানের অভাবে এই কাজটি সকলে করতে পারেন না। শান্তিপুরের বয়ন শিল্পে শ্রমিকেরাই একমাত্র তাঁদের কাজের সুযোগ ও মাসে চার থেকে ছয় হাজার টাকা রোজগারের জন্য সন্তুষ্ট।
অন্য দিকে অসন্তোষ তাঁতিদের মধ্যে সর্বাধিক। তাঁদের কাছে কোনও বিকল্প পথ না থাকায় তাঁরা এই কাজ করতে বাধ্য। শান্তিপুর বয়ন কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত দ্রব্য পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে রফতানি করা হয়ে থাকে। তা সত্বেও তাঁতিদের রোজগার বাড়ে না। শিল্প কেন্দ্রটির উন্নয়নের পথে একটি বড় সমস্যা হল আইন না মানা। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী এগারো ধরনের কাপড় রয়েছে যা কেবলমাত্র হস্তচালিত তাঁতের মাধ্যমে উৎপাদন করা হয়।যদি এই এগারোটি কাপড় যন্ত্রচালিত তাঁত বা মিলের মাধ্যমে উৎপাদন করা হয় তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তবে আজকাল এই দ্রব্যগুলি প্রকাশ্যে বিশাল সংখ্যায় যন্ত্র চালিত তাঁতের মাধ্যমে উৎপাদন করা হচ্ছে। তাঁরা খুব সহজেই শান্তিপুরী শাড়ির কপি করে বাজারে কম দামে বিক্রি করেন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। হস্তচালিত তাঁতিদের হাতে বোনা শাড়ি এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারে না। বাধ্য হয়ে তাঁতিরা ক্ষতি কমাতে সম্পূর্ণ ভাবে মহাজনের উপরে নির্ভরশীল পড়ছেন এবং তাঁদের শাড়ির জন্য যথোপযুক্ত দাম পাচ্ছে না।
বড় কোন সরকারি বা বেসরকারি বিক্রির সংস্থা না থাকায় উৎপাদিত দ্রব্য সারা ভারতে রফতানি হচ্ছে না এবং তা শান্তিপুরের সঙ্কীর্ণ বাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। আসলে শান্তিপুরের তাঁত বয়ন কেন্দ্রের প্রধান সমস্যা হল মহাজনী ব্যবস্থা। প্রথমত, মহাজনেরা শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন দিয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, তাঁরা উৎপাদিত দ্রব্যগুলি মজুদ করে রাখে এবং ইচ্ছেমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে, তাঁতিরা এই পেশা ছেড়ে অন্য রাজ্যে গিয়ে নতুন চাকরির সন্ধান করেন। এমনকি, ব্যাঙ্কগুলিও সুরক্ষার কারণে গরিব তাঁতিদের ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। অসংগঠিত তাঁতিরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না যে তারা ব্যাঙ্ক ঋণ পাবেন। ব্যাঙ্কের পথটি যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন এক মাত্র মহাজনের বিকল্প পড়ে থাকে। তাই তাঁত শিল্পের তাঁত শ্রমিকদের বাইরে যাওয়া বন্ধ করার সহজ উপায় নেই।
২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ঢাকা সফরে গিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন যা বাংলাদেশ থেকে সুতির কাপড় আমদানির পথ খুলে দেয়। তার প্রভাবও শান্তিপুরের তাঁত বয়ন শিল্পে কম নয়। বর্তমানে গুজরাত থেকে আমদানি করা শাড়িও শান্তিপুরের তাঁতিদের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও শান্তিপুর বয়ন শিল্পের উন্নয়নের জন্য অনুমোদিত প্রশাসনিক সংস্থা অনেক ক্ষেত্রে আংশিক ভাবে কাজ করে যদিও এর মূল লক্ষ্য হল বর্ণ এবং রাজনীতির ওপরে উঠে সামগ্রিক উন্নয়ন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কয়েক বছর আগে একটি সরকারি স্কিমে পরিবার প্রতি একটি করে হস্তচালিত তাঁত দেওয়া শুরু করেছিল, বেশিরভাগ পরিবার সুবিধা পেলেও কিছু পরিবার এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মঞ্জুষা, তন্তুজ, বিশ্ব-বাংলা যদি লাভের মুখ দেখে তা হলে আর একটু চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই বাংলার তাঁত ও তাঁতি বাঁচবে। বহু সমস্যা থাকলেও গোষ্ঠী ও সমবায়ই যে দরিদ্র তাঁতিদের মহাজনের হাতে শোষণ বন্ধের একমাত্র পথ, সে বিষয়ে প্রশ্নের কোন অবকাশ নেই, গবেষণা অন্তত সে কথাই বলে।
গোপা সামন্ত বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের শিক্ষিকা, রাকেশ সরকার স্বাধীন গবেষক