সখ্য: আলাপচারী গুরদয়াল মল্লিক (বাঁ দিকে) ও গাঁধীজি (ডান দিকে)। ছবি কৃতজ্ঞতা: রবীন্দ্রভবন
সেই শ্রাবণে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের পথ চেয়ে বসেছিলেন দেশের পশ্চিমতম প্রান্ত থেকে আসা এক পরিব্রাজক। কলকাতা থেকে নির্ধারিত দিনে সে বার ফিরতে পারলেন না কবি, শরীরটা ভাল ছিল না যে। সন ১৩২৬। মাস দুয়েক আগেই পঞ্জাবে শাসকের ‘রাজধর্মদৃষ্টি’-র অন্ধত্ব ও জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নাইটহুড ছেড়েছেন তিনি। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বিশ্বে রোম্যাঁ রোলাঁ-র সঙ্গে চিঠিতে শান্তি নিয়ে ভাবনার আদানপ্রদান শুরু করেছেন। এ দিকে শান্তিনিকেতনে চলছে বিশ্বভারতী সূচনার কর্মযজ্ঞ। দূরদেশ থেকে ছাত্রছাত্রী ও অধ্যাপক আসছেন শান্তিনিকেতন আশ্রমে যোগ দিতে। সেখানকার আদি যুগের ছাত্র প্রমথনাথ বিশী-র বর্ণনায় এই সেই সময় যখন শান্তিনিকেতন দ্রুত পরিণত হচ্ছে এক ‘বাঙালী প্রতিষ্ঠান’ থেকে ‘ভারতীয় প্রতিষ্ঠানে’।
আমাদের এই দূরদেশি মানুষটির মনে রবীন্দ্র-সান্নিধ্যের আকাঙ্ক্ষা অবশ্য জেগেছিল পাঁচ বছর আগেই। গীতাঞ্জলি ও অন্যান্য কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ পড়েছিলেন। আর তাঁর হাতে সম্ভবত পৌঁছেছিল ১৯১৪ সালে প্রকাশিত কবীরের শতেক দোঁহার রবীন্দ্র-কৃত অনুবাদ। মরুদেশ থেকে আগত এই দর্শনপ্রার্থীর বিশেষ প্রিয় ছিল কবীরের দোঁহা।
তিনি লালমাটির দেশে এসেছিলেন যাঁর দর্শন পেতে, সেই কবি ফিরলেন ১৩২৬-এর ২২ শ্রাবণে। বন্ধু চার্লি অ্যান্ড্রুজ় ও কন্যা মীরার সঙ্গে। অবশেষে দেখা হল দু’জনের— রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গুরদয়াল মল্লিকের। পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে অ্যান্ড্রুজ় গুরদয়াল সম্বন্ধে বলেছিলেন, ‘‘বালুচিস্তান থেকে আগত এক নবীন তীর্থযাত্রী!’’ গুরদয়ালের মনে হয়েছিল, অ্যান্ড্রুজ়-এর জন্যই সেই অবিস্মরণীয় মুহূর্ত তৈরি হয়, যে মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ পেয়ে এক অন্য আধ্যাত্মিক জীবনে প্রবেশের অনুভব নিজের মধ্যে টের পান তিনি।
অ্যান্ড্রুজ় সদা-ভ্রাম্যমাণ। কিন্তু ১৯১৪ থেকে অনেকাংশেই শান্তিনিকেতনবাসী। তাঁর সঙ্গে বম্বেতে ১৯১৭ সালে গুরদয়াল মল্লিকের পরিচয়। সেই পরিচয়ের সুবাদে কোয়েটা থেকে বোলপুরে এসে পৌঁছেছিলেন। অ্যান্ড্রুজ় ও গুরদয়ালকে কাছাকাছি আনার একটা বড় সূত্র ছিল রবীন্দ্র-অনুরাগ। অ্যান্ড্রুজ় ১৯১২ সালে গীতাঞ্জলি-র অনুবাদ-শ্রবণ সম্পর্কে বলেছিলেন যে, অপরিচিত নতুন জ্যোতিষ্কের দেখা পাওয়া গেলে যে অবাক বিস্ময়ে মানুষ তাকিয়ে থাকে, তেমনই বিস্ময় তিনি অনুভব করেছিলেন লন্ডনে প্রথম বার গীতাঞ্জলি-র পাঠ শুনে।
তবে তাঁদের দু’জনের এই অনুরাগ শুধু ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর কাব্যের প্রতি মুগ্ধতা দিয়ে ঘেরা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম ও সমাজ-রাজনীতি ভাবনার সহমর্মী ছিলেন এঁরা। অ্যান্ড্রুজ়-কে নিয়ে কিছু চর্চা হয়েছে, বিশেষত গাঁধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সেতুবন্ধন প্রসঙ্গে। কিন্তু বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছেন বালুচিস্তানের গুরদয়াল মল্লিক এবং আরও অনেকে। ‘স্বাজাতিক সঙ্কীর্ণতা’-র ঊর্ধ্বে উঠতে পারিনি বলে নিজের দেশের নানা প্রান্ত থেকে সে সময় শান্তিনিকেতনে আসা মানুষদের ততটা উৎসাহ নিয়ে জানার চেষ্টা করিনি, যেমনটা করেছি নিজের জায়গার, নিজেদের গোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে।
কবির ডাকে করাচির একটি সওদাগরি অফিসের চাকরি ছেড়ে গুরদয়াল আসেন ইংরেজি পড়াতে, ১৯২০-২১ সাল নাগাদ। এর পর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এই মানুষটি বারে বারে ফিরে এসেছেন শান্তিনিকেতনে, কিছু দিন করে পড়িয়ে গিয়েছেন তিনি। ফারসি, উর্দু, পশতু, সিন্ধি ও গুজরাতি জানা এই আত্মভোলা শিক্ষক ভোরবেলা স্নান করে নিজের ঘরে ফেরার সময় গান গাইতেন এবং তাঁর গান শুনে ঘুম ভাঙত ছাত্রদের।
১৯২৩ সালে রবীন্দ্রনাথের করাচি ভ্রমণ কালে তাঁকে চমৎকার সুফি গান শোনানোর ব্যবস্থা করেন গুরদয়াল। অচিরেই কবির অনুরোধ আসে গুরদয়ালের কাছে, বিশ্বভারতীতে উত্তর-পশ্চিমের সুফি সাধকদের নিয়ে কিছু বলতে হবে। যে জায়গাটাকে ‘সমস্ত জাতিগত ভূগোলবৃত্তান্তের অতীত’ করে তুলতে চেয়ে রবীন্দ্রনাথ এক ‘সর্ব্বজাতিক মনুষ্যত্বচর্চার কেন্দ্র’-এর কল্পনার কথা লিখেছিলেন, সেখানেই কয়েক বছর পর ‘মিসটেকস অব সিন্ধ’ নামে গুরদয়াল দেন একটি বক্তৃতামালা। এক ‘বিশ্বজাতিক মহামিলনযজ্ঞের প্রতিষ্ঠা’-র আয়োজনে এ ভাবেই শরিক হয়ে যান তিনি, যেখানে— কিছু কালের জন্য হলেও— ভৌগোলিক, রাষ্ট্রীয়, জাতিগত ও ধর্মীয় ঘেরাটোপের বাইরে বিদ্যা উৎপন্ন হওয়ার একটি ব্যতিক্রমী ধারা ভারতের পরাধীনতা-মুক্তির অন্বেষণেই সূচিত হয়েছিল। পরে গুরদয়ালের ওই বক্তৃতামালা বই হয়ে বেরোলে উৎসর্গপত্রে লেখা হয়— আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। গাঁধী ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি বইও লিখেছিলেন গুরদয়াল, যেটি প্রায় হারিয়ে গিয়েছে বলা যায়।
ধুতি-চাদর পরা সাহেব অ্যান্ড্রুজ়-এর সঙ্গে ছোটখাটো চেহারার পঠান গুরদয়ালের সখ্য নতুন মাত্রা পেয়েছিল ১৯১৯-এর অক্টোবরে। প্রথম শান্তিনিকেতন দর্শনের পর তখন অল্প দিন হল করাচি ফিরে গিয়েছেন গুরদয়াল। এমন সময় হঠাৎ অ্যান্ড্রুজ় তাঁকে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন লাহৌরে আসার জন্য। জালিয়ানওয়ালা বাগের ঘটনার তদন্তের জন্য ইংরেজ শাসক তত দিনে প্রবল চাপের মুখে পড়ে গঠন করেছে হান্টার কমিটি। কংগ্রেসের নেতারা পঞ্জাবের সাধারণ মানুষের সাক্ষ্য-বয়ান জড়ো করবার জন্য যে কমিটি তৈরি করেছিলেন, অ্যান্ড্রুজ়কে ডেকে নেওয়া হয়েছিল তার কাজে। এই পর্বে গুরদয়াল ছিলেন তাঁর সর্ব ক্ষণের সঙ্গী।
পঞ্জাবের আতঙ্কের আবহে কাজ করাকালীন দু’-চারটি মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতার কথা লিখে রেখে গিয়েছেন গুরদয়াল, যা আমরা জালিয়ানওয়ালা বাগের ইতিহাসে প্রান্তবর্তী স্বর হিসেবে ধরতে পারি। একটা ঘটনা বলি। ওখানকার একটি মফস্সল শহরে এক রবিবার সকালে যখন তাঁরা গির্জায় গিয়ে পৌঁছন, তখন প্রার্থনা শুরু হতে চলেছে। তাঁরা দু’জন নিঃশব্দে ঢুকে শেষ সারিতে গিয়ে বসেছেন। এমন সময় হঠাৎ সেখানকার এক কর্তাব্যক্তি উঠে এসে তাঁদের দু’জনকে প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে গির্জা থেকে বার করে দেন। সেই সাহেবের কাছে তাঁর আচরণের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হলে, ক্রুদ্ধ উত্তর আসে, ‘‘বিদ্রোহীদের কোনও স্থান নেই জিশুর এই গৃহে!’’ চলে আসতে আসতে অ্যান্ড্রুজ় বলেছিলেন, ‘‘কিন্তু জিশুও কি বিদ্রোহী ছিলেন না!’’
অ্যান্ড্রুজ় তাঁর স্বজাতির মানুষদের অন্যায়ের তদন্তের ভার নিয়েছিলেন বলেই জুটেছিল এই গলাধাক্কা! এখানে মনে রাখা জরুরি যে পঞ্জাবে সামরিক শাসন ঘোষিত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই অ্যান্ড্রুজ় কাগজে লেখালিখি শুরু করেছিলেন ওখানকার মানুষের উপর ঘটে চলা প্রচণ্ড অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এই সময় দিল্লি থেকে তাঁর চিঠিপত্র নিয়মিত আসত শান্তিনিকেতনে, যেগুলো পড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘মন উত্তপ্ত’ হয়ে উঠত বলে কবি নিজেই লিখেছেন। মে মাসের গোড়ার দিকে অ্যান্ড্রুজ় অমৃতসর পর্যন্ত পৌঁছে পুলিশি বাধা পেয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এর আগে শ্বেতাঙ্গ-শাসিত উপনিবেশগুলিতে অত্যাচারিত ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষের পাশে দাঁড়াতে তো তিনি বারে বারেই ছুটে গিয়েছেন।
এ বারে পঞ্জাব থেকে শান্তিনিকেতনে ফিরলে কবি অ্যান্ড্রুজ়-এর মুখেই ও’ডায়ারী অত্যাচারের ভয়াবহতার কথা অনেকটা শোনেন এবং এই অন্যায়ের প্রতিবাদ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের অনুরোধ নিয়ে গাঁধীর সঙ্গে কথা বলতে যান অ্যান্ড্রুজ়। এ তো গেল নাইটহুড ত্যাগপত্র লেখার আগের কথা। পরবর্তী অবিভক্ত পঞ্জাবের গ্রাম-শহর ঘুরে চিঠির পর চিঠিতে তিনিই কবির কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ও জালিয়ানওয়ালা বাগ গণহত্যার পরে পঞ্জাবের মানুষের চরম লাঞ্ছনার কথা।
রবীন্দ্রনাথ-অ্যান্ড্রুজ়-গুরদয়াল এই ত্রয়ীর মধ্যে যে আত্মীয়তার বন্ধন ও বন্ধুত্বের উন্মেষ আমরা দেখি, তা আবর্তিত হয় জাতিপ্রেমের ঊর্ধ্বে দেশপ্রেম ও দেশসেবার বিকল্প ধারার সন্ধানে। ‘ন্যাশনাল মহত্ত্ব’-কে বর্জন করে দেশকে ভালবাসার অন্য পথ খুঁজেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই পথে নানা ভাবে তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন অ্যান্ড্রুজ় ও গুরদয়াল মল্লিক। রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক প্রতিবাদে সংহতি জানিয়ে যেমন, তেমনই ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্পে তাঁর স্বদেশি শিক্ষা ও সমাজ-পুনর্গঠন পরিকল্পনায় সক্রিয় অংশ নিয়ে। কবির তো বরাবরই বিপুল আস্থা ছিল সেই সব মানুষের উপর, যাঁদের ‘ভ্রূকুঞ্চিত পাথরের চাঁইয়ের’ পাশে ‘দুর্বল ও অকিঞ্চিৎকর চারাগাছ’ মনে হতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে বিশ্ব জুড়ে এ রকম মানুষদের সশ্রদ্ধ সন্ধান রাখতেন রবীন্দ্রনাথ, যাঁরা স্বল্পখ্যাত হলেও যুদ্ধ ও রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অনেক অপমান সয়ে একা লড়ে গিয়েছেন, যেমন ব্রিটিশ সাংবাদিক-রাজনীতিবিদ ই ডি মোরেল। তিনি বিশ্বাস করতেন মোরেলের মতো মানুষেরা হলেন অশেষ জীবনীশক্তি সংবলিত এক একটি চারাগাছ, যা পাথরের চাঁইয়ের মতো মনুষ্যত্ব গুঁড়িয়ে-দিতে-পারা দানবীয় সব সংস্থার আস্ফালন প্রতিরোধ করতে পারে। এমন মানুষদের মধ্যে সজীব সখ্য হয়ে উঠতে পারে বিরাট শক্তির উৎস, যা সব রকম রাজনৈতিক পরাধীনতা ও সামাজিক সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে— অ্যান্ড্রুজ় ও গুরদয়ালের মতো রবীন্দ্র-সহযোগী আমাদের তা মনে করিয়ে দেন।