বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছেন গ্রেটা থুনবার্গ
রাষ্ট্রপুঞ্জে বক্তৃতা দেওয়ার সময় প্রকৃতি ধ্বংসের কারণ হিসেবে সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্রনেতাদের দায়ী করেছে গ্রেটা থুনবার্গ। ১৬ বছরের এই কিশোরীর প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে শুরু করা আন্দোলন মাত্র এক বছরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতে। বাধাও কম আসেনি। গ্রেটা ‘অ্যাসপারগার সিন্ড্রোম’ নামক জটিল স্নায়ুরোগে আক্রান্ত। ফলে কথাবার্তা তথাকথিত স্বাভাবিক মানুষের মতো নয়। সে নিয়ে উড়ে এসেছে কটাক্ষ। গ্রেটা সেই কটাক্ষের জবাবে বলেছে এই রোগই তার ‘সুপার পাওয়ার’।
গ্রেটা যে ভাবে গোটা বিশ্বকে নড়িয়ে দিয়েছে, তা সুপার পাওয়ারের চেয়ে কম কিছু নয়। তবে শুধুমাত্র প্রকৃতি বাঁচানোর জোরালো স্বর হিসেবে নয়, তার আন্দোলনের গুরুত্ব আরও বিস্তৃত, আরও গভীর। একা প্ল্যাকার্ড হাতে বসে থাকা থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জে বসে রাষ্ট্রনেতাদের সমালোচনা করা, তাঁদের পৃথিবী ধ্বংসের জন্য সরাসরি দায়ী করা আসলে ক্ষমতাবানদের আস্ফালনকে অস্বীকার করা। কিন্তু ক্ষমতাবান কারা? ক্ষমতা আসলে কী?— ষোড়শ শতকের ব্রিটিশ দার্শনিক টমাস হবস ক্ষমতাকে দেখেছিলেন একটি দেশের চালকের আসনে থাকা ব্যক্তিদের সম্পত্তি হিসেবে যা নীচের তলার মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। হবস এই ক্ষমতা ব্যবস্থার নাম দিয়েছিলেন ‘লেভয়াথান’। যার অর্থ— শালাকার সামুদ্রিক দৈত্য। এই দৈত্যাকার ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি প্রতি দিন।
ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর মতে ক্ষমতার এক রূপ হল ‘ডিসিপ্লিন’ বা শৃঙ্খলা। তাঁর ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’ বইয়ে জেরেমি বেন্থামের কাল্পনিক জেলখানা ‘প্যানঅপ্টিকন’-এর বর্ণনা রয়েছে। সেখানে পাঁচিল বা লোহার দরজার বদলে রয়েছে এক সূক্ষ্ম নজরদারি ব্যবস্থা যা কয়েদিদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তোলে। তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সোজা। এই নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিও এক ধরনের ক্ষমতা, যা মিশে থাকে সমাজের প্রতি ক্ষেত্রে। ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’-এর প্যানঅপ্টিসিজ়ম অধ্যায়ের শেষ লাইনে ফুকো লিখেছেন, “এটা কি কোনও অবাক হওয়ার মতো ঘটনা যে আসলে কারখানা, স্কুল, সেনা ছাউনি, হাসপাতাল, এই সব ক’টিই এক একটি জেলখানা?” যারা এই ব্যবস্থায় শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে পড়ে, ফুকো তাদের নাম দেন ‘ডোসাইল বডি’ বা আজ্ঞাবাহক।
গ্রেটার আন্দোলনের প্রাথমিক গুরুত্ব হল সে নিজেকে ডোসাইল বডিতে পরিণত হতে দেয়নি। থুনবার্গের উত্থানের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি কার্টুন ভাইরাল— কাচের পাত্রে থাকা একটা ছোট্ট মাছ বলছে, ‘পাত্রে ফাটল, জল বেরিয়ে যাচ্ছে, আমাদের ব্যবস্থা করা দরকার।’ বড় মাছ রেগে গিয়ে বলছে, ‘অঙ্ক কষায় মন দাও।’ কার্টুনে ছোট্ট মাছটিকে আঁকা গ্রেটার আদলে। ডোসাইল বডি কারা এবং গ্রেটা কেন তা নয়, তার উদাহরণ এই কার্টুন।
কিন্তু গ্রেটা কী ভাবে পারল? সুইডিশ কিশোরীর রোগই তার সুপার পাওয়ার, কথাটি মিথ্যা নয়। স্নায়ুবিজ্ঞানী ডেভিড স্যান্ডারের তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের মস্তিষ্কের অ্যামিগডেলা অংশটি বাইরের প্রকৃতিতে ঘটা ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করে। শরীর অ্যামিগডেলার নির্দেশমতো প্রতিক্রিয়া জানায়। অ্যামিগডেলা শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় এমন পদক্ষেপ করতে সাহায্য করে। তবে মস্তিষ্কের বেশ কিছু অংশ অ্যামিগডেলাকে প্রভাবিত করে। তখন কোনও দরকারি পদক্ষেপ করায় কী কী অসুবিধেয় পড়তে হতে পারে ভেবে পিছিয়ে আসতে হয়। এই অংশগুলির কাজ স্মৃতি ধরে রাখা, ভয় পাওয়া ও পূর্বজ্ঞানের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ ‘প্রেডিক্ট’ করা। এই অংশগুলিতে ভয়ের স্মৃতি তৈরি করে দেয় ক্ষমতা ব্যবস্থা, আর কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করতে বাধা দেয় শেখানো শৃঙ্খলা। ফলে মস্তিষ্কে তৈরি হয় জেলখানা। কিন্তু অ্যাসপারগার সিন্ড্রোমের ক্ষেত্রে অ্যামিগডেলার সঙ্গে মস্তিষ্কের বাকি অংশগুলির যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বা দুর্বল। ফলে শুধু অ্যামিগডেলার নির্দেশ মেনেই কোনও ঘটনার প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া দেয় রোগাক্রান্ত ব্যক্তি। গ্রেটার ক্ষেত্রেও এমনই ঘটেছে। ফলে রাষ্ট্রনায়কদের ‘হাও ডেয়ার ইউ’ বলার সময় পাল্টা কটাক্ষের ভয় সে পায়নি। লরেন্স অসবোর্ন লিখছেন, গ্রেটার মতোই অ্যাসপারগার সিন্ড্রোমের একাধিক কেস স্টাডি যেখানে সমাজের নানা স্তরে লুকিয়ে থাকা ক্ষমতাকে অস্বীকার করার উদাহরণ আছে।
তবে গ্রেটার আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, সে শুধু ক্ষমতার প্রচলিত ধারণা ভাঙেনি, মনে করিয়ে দিয়েছে নতুন ক্ষমতার জন্ম কী ভাবে হয়। দার্শনিক ব্রুনো লাতুর নতুন ক্ষমতার জন্মের এক তত্ত্ব দেন। ফুকোর মতোই তিনি ক্ষমতা সমাজের উপরের তলায় কিছু ব্যক্তির মধ্যে পুঞ্জীভূত এমনটা মানেন না। প্রবন্ধে লাতুর ক্ষমতাকে ব্যাখ্যা করেছেন পদার্থবিদ্যার সাহায্যে। তাঁর মতে, ক্ষমতা হল জাড্য ও ভরবেগ এবং তা রয়েছে সমষ্টির মধ্যে, সাধারণের মধ্যে। প্রচলিত ক্ষমতার ধারণাকে রোধ করবে কোনও ব্যক্তির নতুন আইডিয়া বা ভাবনা। ক্ষমতার এই গতিরোধ জাড্য। তার পর সেই ভাবনা সঞ্চারিত হবে আরও ব্যক্তির মধ্যে, ধীরে ধীরে সেই ভাবনা সমষ্টির মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে তৈরি করবে ভরবেগ। ‘মুভমেন্ট’ অর্থাৎ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করার তাগিদ। এ ভাবেই সৃষ্টি হবে ভরবেগ, যা আসলে নতুন ক্ষমতা। এই ক্ষমতা নিপীড়নকারী ক্ষমতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো একটা সমষ্টিগত ‘আইডিয়া’ বা ভাবনা। এটিই নতুন ক্ষমতা। এই ক্ষমতা সাধারণ মানুষের। গ্রেটা এই কাজটিই করেছে। তার একার ভাবনা প্রথমে তৈরি করেছে জাড্য। পরে তা ধীরে ধীরে ভরবেগের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
নিজের রোগকে সুপারপাওয়ার বলে গ্রেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, সুপার পাওয়ারের আসল অর্থ কী! তা রয়েছে সাধারণ মানুষেরই মধ্যে। পদ্ধতি একটাই, নিজেদের ডোসাইল বডিতে পরিণত হতে না দিয়ে সমষ্টির উদ্বুদ্ধকারী ভরবেগ ছড়িয়ে দেওয়া। শুধু প্রকৃতি বাঁচানোয় নয়, যে কোনও মানবতাবিরোধী নিপীড়নের গতি রোধ করবে এই সুপার পাওয়ার।