প্রতীকী ছবি।
একটা জঘন্য ঘটনা এ ভাবে বার বার ঘটে কী করে? মাত্র কয়েকটা মাসে কলকাতার তিনটে স্কুল শিরোনামে চলে এল পড়ুয়ার উপর শিক্ষকের যৌন নির্যাতনের অভিযোগকে কেন্দ্র করে। মৃদু ভাষ্যে অভিযোগটা উঠল, তার পর মুখের উপরে কেউ নস্যাৎ করে দিলেন, আর তখনই সব কিছু তড়িঘড়ি ধামাচাপা পড়ে গেল— এমন কিন্তু নয়।
প্রত্যেক বারই পড়ুয়ার উপর শিক্ষকের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানালেন অভিভাবকরা। বিচার না পেয়ে থানায় গেলেন বা সম্মিলিত বিক্ষোভের পথে হাঁটলেন। বিক্ষোভ তীব্র আকার নিল, ধুন্ধুমার হল, খণ্ডযুদ্ধ বাধল, অচলাবস্থা তৈরি হল, আর কখনও এমন ঘটবে না বা ঘটতে দেওয়া হবে না বলে শপথ নেওয়া হল প্রান্তে প্রান্তে। কিন্তু আবার অন্য কোথাও একই অভিযোগ সামনে এল, একই ভাবে ধুন্ধুমারের দিকে গড়াল ঘটনাপ্রবাহ।
এই ছবিটা কি আদৌ কাম্য? একের পর এক স্কুল থেকে পড়ুয়ার উপর শিক্ষকের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ সামনে আসছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ উঠছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে ধুন্ধুমার গোলমাল হচ্ছে এবং তার পরে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ হচ্ছে। পরিস্থিতিটা যে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, তা নিয়ে সংশয় নেই।
কিন্তু এ দুর্ভাগ্য কার? স্কুলের, নাকি পড়ুয়ার, নাকি প্রশাসনের, নাকি সমগ্র সমাজটার? উত্তরটা খুঁজে পাওয়া খুব জরুরি। না হলে কোনও দিন এই প্রবণতায় ছেদ টানতে পারব না আমরা।
জি ডি বিড়লা স্কুল, এম পি বিড়লা স্কুল, কারমেল প্রাইমারি— আড়াই মাসেরও কম সময়ে তিন স্কুলে একই ঘটনা। যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ঘিরে কারমেল যখন রণক্ষেত্র, তখন জেলা থেকেও একই রকম খবর আসতে শুরু করল। উত্তর ২৪ পরগনার গোপালনগরের স্কুলেও শ্লীলতাহানির অভিযোগ শিক্ষকের বিরুদ্ধেই। বীরভূমের সিউড়ির স্কুলে অভিযোগটা বহিরাগত যুবকের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ যার বিরুদ্ধেই হোক, অভিযোগটা সর্বত্র একই। ছবিটাও প্রায় হুবহু মিলে যাচ্ছে জেলার প্রত্যন্ত প্রান্ত থেকে রাজধানীর ধনী মহল্লা পর্যন্ত। সর্বত্রই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে— স্কুলে ছাত্রীরা আদৌ নিরাপদ তো?
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
প্রথমেই প্রশ্ন তুলতে হয় স্কুল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে। বার বার একই রকম অভিযোগ সামনে আসছে, কিন্তু স্কুলগুলো যথোপযুক্ত সর্তকতা অবলম্বন করছে না। যে স্কুলে ঘটনা ঘটছে, সেই স্কুল হয়ত ঈষৎ নড়েচড়ে বসছে। কিন্তু পাশের স্কুলটাই অবিচলিত থেকে যাচ্ছে। পড়ুয়ার উপর স্কুলে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ যত বার সামনে এল, তত বারই সিসিটিভি নজরদারির কথা উঠে এল। সিসিটিভি নেই কেন, প্রশ্ন উঠল।
গোটা স্কুল চত্বরকে সিসিটিভি নজরদারির আওতায় আনা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল। স্কুলের সামগ্রিক নিরাপত্তা বাড়ানো হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হল। কিন্তু সবর্ত্রই বুদ্ধিটা যেন চোর পালিয়ে যাওয়ার পরে বাড়ছে। যে বাড়িতে এখনও চোর হানা দেয়নি, সে বাড়ি যেন জানেই না যে, পাশের বাড়ির ঘটনাটা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত, অভিজ্ঞতা অর্জন করা উচিত। জি ডি বিড়লা এবং এম পি বিড়লা স্কুলে উপর্যুপরি ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে যাওয়ার পরও কারমেল প্রাইমারি স্কুলে একই রকম ঘটনা ঘটার অবকাশ রইল কী ভাবে, প্রশ্নটা তা নিয়েই।
পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্নের অবকাশ যথেষ্টই। এই ধরনের অভিযোগের ক্ষেত্রে কী ভাবে পদক্ষেপ করতে হবে, কী ভাবে বিক্ষোভ সামাল দিতে হবে, পুলিশের তা জানা উচিত। প্রতি বারই বিক্ষোভ সামাল দিতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা হয়েছে পুলিশের। নিরস্ত্র জমায়েতের উপরে বা বিক্ষোভরত অভিভাবকদের উপরে লাঠি চালানো হয়েছে। পুলিশের এই ভূমিকা কি আদৌ দৃষ্টিনন্দন? সব ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আইন-শঙ্খৃলা বলবৎ করতে হয়, এমনটা নয়। বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে বলপ্রয়োগই একমাত্র রাস্তা, তাও বলা যায় না।
জনসাধারণের সঙ্গে কার্যকরী যোগাযোগ স্থাপনের জন্য লাঠি বা গুলির ভাষা ছাড়াও পুলিশকে আরও অনেক রকমের ভাষা জানতে হয়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তেমন কোনও ভাষার প্রয়োগ এ সব ক্ষেত্রে পুলিশের তরফ থেকে দেখা যাচ্ছে না। সব ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পরে পুলিশ পৌঁছচ্ছে এবং বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘাত চরমে পৌঁছচ্ছে। পর পর এত বার একই রকম ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও পরিস্থিতির মোকাবিলায় পুলিশের এত অপটুতা কেন? কেন এ ধরনের ঘটনার মোকাবিলার কোনও সুনির্দিষ্ট কৌশল তৈরি করা গেল না এখনও?
‘বেটি বচাও, বেটি প়ঢাও’— স্লোগান দিচ্ছে আমাদের দেশ। সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা মেয়েদের সামগ্রিক বিকাশে উৎসাহ যোগাচ্ছে। কন্যাশ্রী প্রকল্প আরও বেশি করে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে বলছে। সেই দেশে বা সেই রাজ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের নিরাপত্তার হালটা এই রকম! এই দৃশ্যপটটা তৈরি হওয়ার পরেও মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে নিরাপদ বোধ করবেন অভিভাবকেরা? পর পর অঘটনগুলো সামনে আসার পরে প্রশাসন তথা সরকারই বা কোন মুখে নারীশিক্ষার বিস্তার নিয়ে কথা বলবে? কিন্তু নারীশিক্ষার বিস্তার নিয়ে সরকারি উদ্যোগ সত্যিই জরুরি।
আরও পড়ুন
শিশুর ‘যৌন নিগ্রহ’ ঘিরে ধুন্ধুমার কারমেল স্কুলে, ধৃত নাচের শিক্ষক
মেয়েদের আরও বেশি করে স্কুল-কলেজে পাঠানোটাও জরুরি। অতএব জি ডি বিড়লা, এম পি বিড়লা, কারমেল প্রাইমারি স্কুলে তৈরি হওয়া দৃশ্যগুলো যে ঘটনা পরম্পরার জন্ম দিল, সেই পরম্পরায় অবিলম্বে ছেদ টানা জরুরি। আর কোনও স্কুলে এক জন পড়ুয়ার সঙ্গেও এমন ঘটনা ঘটবে না— এই অঙ্গীকার নিয়ে এই মুহূর্ত থেকে কাজ শুরু করতে হবে প্রশাসনকে। পড়ুয়াদের নিরাপত্তার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ দায়বদ্ধ হতে হবে প্রতিটি স্কুল কর্তৃপক্ষকেও। এখনও পর্যন্ত কয়েকটি ঘটনার বা অঘটনের সমাহার হিসেবে ধরা দিচ্ছে ছবিটা। এর পরেও যদি কিছু ঘটে এই রকমই, তা হলে একে আর অঘটনের সমাহার বলা যাবে না, প্রবণতা বলতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়ার উপর যৌন নির্যাতন যাতে প্রবণতা না হয়ে ওঠে, তার জন্য যা কিছু পদক্ষেপ করা জরুরি, তা এখনই করা হোক।