হায় পথবাসী

গৃহহীনদের ‘আশ্রয়’ তৈরির জন্য, তাঁহাদের ব্যবহারযোগ্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা নির্মাণের জন্য সুপ্রিম কোর্ট এবং বিবিধ হাইকোর্ট নানা সময়ে নির্দেশ দিয়াছে। রাজ্য সরকারগুলি সে কাজে কতটা তৎপর, তাহার নিদর্শন মিলিয়াছে সমীক্ষায়— গৃহহীনদের মধ্যে মাত্র বারো শতাংশ কখনও কোনও সরকার-নির্মিত আশ্রয়ে থাকিবার সুযোগ পাইয়াছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৯ ০০:৪৫
Share:

ছবি: সংগৃহীত

দারিদ্রের এক প্রধান কারণ সামাজিক অন্যায়, মনে করাইল একটি সমীক্ষা। দলিত, জনজাতি ও অন্যান্য পশ্চাৎপদ জাতির মানুষেরা ভারতে গৃহহীনদের আশি শতাংশ। এই আর্থ-সামাজিক বঞ্চনা প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলিতেছে। পাঁচ জন গৃহহীনের তিন জনই জন্মাইয়াছেন সেই শহরে, যেখানে তিনি পথবাসী। ইহাতে একটি ভ্রম ভাঙিবে। কাজের খোঁজে গ্রাম হইতে শহরে, অথবা এক শহর থেকে অপর শহরে পরিযায়ী মানুষদের অনেকে নূতন শহরের পথেই আশ্রয় লইতে বাধ্য হন, এই ধারণাই এত দিন কাজ করিত। শেষ জনগণনায় ভারতে সতেরো লক্ষ গৃহহারা মানুষ মিলিয়াছিল। তাঁহারা অধিকাংশই পরিযায়ী শ্রমিক, এই ধারণাই এত দিন ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক অনুদানে করা অসরকারি সমীক্ষাটি দেখাইল, সে ধারণা ভুল। নিজের জন্মের শহরে সারা জীবন কাটাইয়াও দরিদ্র, প্রান্তবাসী মানুষ নিজের মাথার উপর আচ্ছাদন জুটাইতে পারে না। বড় শহরগুলিতে দরিদ্রের বাসস্থান জুগাইবার দায় সরকার অস্বীকার করিতে পারে না। ইউপিএ সরকার ২০১১ সালে শহরের দরিদ্রদের জন্য ‘রাজীব আবাস যোজনা’ ঘোষণা করে। ২০১৫ সালে এনডিএ সরকার ঘোষণা করিল ‘২০২২ সালের মধ্যে সকলের জন্য গৃহ’ যোজনা। তবে ইহা বস্তিবাসীর পুনর্বাসনের প্রতি, স্বল্পবিত্তকে গৃহঋণ দানের প্রতি অধিক মনোযোগী। গৃহহীন কিন্তু এই সব প্রকল্পেও প্রান্তবাসী।

Advertisement

গৃহহীনদের ‘আশ্রয়’ তৈরির জন্য, তাঁহাদের ব্যবহারযোগ্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা নির্মাণের জন্য সুপ্রিম কোর্ট এবং বিবিধ হাইকোর্ট নানা সময়ে নির্দেশ দিয়াছে। রাজ্য সরকারগুলি সে কাজে কতটা তৎপর, তাহার নিদর্শন মিলিয়াছে সমীক্ষায়— গৃহহীনদের মধ্যে মাত্র বারো শতাংশ কখনও কোনও সরকার-নির্মিত আশ্রয়ে থাকিবার সুযোগ পাইয়াছেন। ইহা আশ্চর্য নহে। গৃহহীনতার সহিত অধিকারহীনতার সংযোগ গভীর। যদিও অধিকাংশ পথবাসীর নাগরিকত্ব লইয়া সংশয় নাই— প্রায় সত্তর শতাংশের কোনও না কোনও নাগরিক পরিচয়পত্র রহিয়াছে, তিন জনের মধ্যে দুই জন আধার কার্ড করাইয়াছেন। প্রায় চল্লিশ শতাংশের ভোটার কার্ড রহিয়াছে, এবং তাঁহারা প্রায় সকলেই ভোট দিয়াছেন। তৎসত্ত্বেও সরকারি সুযোগ-সুবিধা অধরা। সাতাত্তর শতাংশ গৃহহীন কোনও সুবিধাই পান না, মাত্র আঠারো শতাংশ রেশনের সুবিধা পান। গৃহহীনতা দারিদ্রকে আরও গভীর করিতেছে।

ইহার কারণ আন্দাজ কঠিন নহে। নাম লিখিবার পরেই লিখিতে হয় ‘ঠিকানা’। কারণ বাসস্থান ব্যক্তির পরিচিতিরও একটি অংশ। অতি-জীর্ণ আবাস দরিদ্র গৃহস্বামীকে আরাম দিতে ব্যর্থ হইলেও, সামাজিক নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা দেয়। গৃহহীনের তাহাও নাই। ভারতের সতেরো লক্ষ গৃহহীন মানুষ বস্তুত মর্যাদার সহিত বাঁচিবার মৌলিক অধিকার হইতে বঞ্চিত। গৃহহীনের বিপন্নতার তুলনা নাই। পুলিশ ও অপরাধী, উভয়ই তাঁহাদের তাড়াইয়া বেড়ায়। সন্তানের শিক্ষা বা অসুখের চিকিৎসা তাঁহাদের জোটে না। যদিও তাঁহাদের আশি শতাংশই দিনমজুরির কাজ করিয়া জীবিকা অর্জন করেন, তাঁহারা ভিখারি, তস্কর, সমাজবিরোধী বলিয়া বিবেচিত হন। কেবল মাথার উপরের ছাদ নহে, নাগরিকের সকল অধিকারই তাঁহাদের প্রাপ্য। গৃহহীনদের পুনর্বাসনের জন্য আবাস প্রকল্পই যথেষ্ট নহে, নিবিড় কর্মসূচি প্রয়োজন।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement