প্রকৃত সংস্কার কাহাকে বলে, ভারতীয় রাজনীতিতে এই প্রশ্নের সদুত্তর বিরল। অতএব, আয়কর ব্যবস্থায় যে সংস্কারের কথা ঘোষিত হইল, তাহাকেই ‘বৃহৎ সংস্কার’ বলিয়া দাবি করিয়াছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রকৃত প্রস্তাবে, আয়কর ব্যবস্থার সংস্কারের যে ধারাটি অন্তত তিন দশক যাবৎ চলিতেছে, বর্তমান সংস্কার তাহারই পরবর্তী ধাপ। অগ্রগতি অবশ্যই। কিন্তু, ইহাকে ‘বৈপ্লবিক’ বলিবার কারণমাত্র নাই। কয়েকটি উদাহরণে কথাটি স্পষ্ট হইবে। করদাতাদের সনদ প্রস্তুত করিয়া প্রধানমন্ত্রী জানাইয়াছেন, অতঃপর ধরিয়া লওয়া হইবে প্রত্যেক করদাতাই সৎ ভাবে আয়কর প্রদান করিতেছেন। নাগরিকের প্রতি এই বিশ্বাসকে যদি বৈপ্লবিক বলা হয়, তবে বিপ্লবটি ঘটিয়াছিল ১৯৮০-র দশকের শেষ প্রান্তে। তখনই সিদ্ধান্ত হয় যে, মোট রিটার্নের একটি সামান্য অংশের স্ক্রুটিনি হইবে। নাগরিকদের সততার প্রতি আস্থা না থাকিলে এই ব্যবস্থা হইবার কথা নহে। আয়কর নির্ধারণ বা জরিমানা ইত্যাদির ক্ষেত্রে কোনও পক্ষপাত বা দুর্নীতির অবকাশ যাহাতে না থাকে, তাহা নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে অ্যাসেসমেন্টের দায়িত্ব লটারির মাধ্যমে বণ্টনের ব্যবস্থাও হইয়াছিল বহু বৎসর পূর্বে। কম্পিউটারের মাধ্যমে কর নির্ধারণ, বেঙ্গালুরুর সেন্ট্রালাইজ়ড প্রসেসিং সেন্টার-এর মাধ্যমে কেন্দ্রায়িত কর পরীক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদিরও সূচনা নরেন্দ্র মোদী দিল্লির তখ্তে বসিবার ঢের পূর্বে। এই দফায় যে পরিবর্তনটি গুরুত্বপূর্ণ, তাহা হইল, অতঃপর কর পরীক্ষার ব্যবস্থাটি আঞ্চলিক না থাকিয়া সর্বভারতীয় হইবে। ফলে, কর নির্ধারণে দুর্নীতির সম্ভাবনা আরও কমিবে বলিয়াই প্রত্যাশা। এই সংস্কার বাবদ যতটুকু কৃতিত্ব প্রাপ্য হয়, প্রধানমন্ত্রী সেটুকু দাবি করিতে পারেন। তবে, গত বৎসর পরীক্ষামূলক ভাবে ব্যবস্থাটি চালু করিবার পর তাহার ফলাফল বিচার না করিয়াই তাহাকে গোটা দেশের স্কন্ধে চাপাইয়া দেওয়ার দায়টিও প্রধানমন্ত্রীর উপরই বর্তাইবে।
কিন্তু, যে সংস্কারের প্রত্যাশায় যুগের পর যুগ কাটিয়া যায়, নরেন্দ্র মোদীও তাহার কথা বলিলেন না— কৃষি-আয়কে আয়করের আওতায় আনিবার কথা। হয়তো বলিতে সাহস করিলেন না, যেমন তাঁহার পূর্বসূরিরাও করেন নাই। কেন কৃষির ন্যায় এমন বৃহৎ একটি ক্ষেত্রের আয় করব্যবস্থার বাহিরে থাকিবে, ভোটের রাজনীতি ব্যতীত তাহার কোনও উত্তর নাই। এবং, এই ব্যবস্থার সুবিধা ক্ষুদ্র বা মাঝারি কৃষকদের জন্যও নহে— তাঁহাদের আয় যতখানি, তাহা সচরাচর ছাড়ের সীমা ছাড়ায় না। এই ব্যবস্থার সুবিধা পান বৃহৎ ও অতিবৃহৎ কৃষকরা। ততোধিক সুবিধা পান এমন বহু ধনী ব্যক্তি, যাঁহাদের কৃষির সহিত দূরদূরান্তে সম্পর্ক নাই, কিন্তু হিসাবের খাতায় তাঁহাদের আয়ের বড় অংশ কৃষি-আয় হিসাবে চিহ্নিত। এই অর্থহীন ব্যবস্থাটি দূর করিতে পারিলে তাহাকে বলা যাইত সংস্কার। অপেক্ষাকৃত দরিদ্র কৃষকদের জন্য কর ছাড়ের ব্যবস্থা থাকুক, যেমন থাকে কম আয়ের চাকুরিজীবীদের ক্ষেত্রে। কিন্তু কৃষিকে করহীন রাখিবার রাজনৈতিক খেলা বন্ধ হউক।
প্রকৃত সংস্কার হইত আয়করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করা। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং জানাইয়াছেন, দেশে মাত্র দেড় কোটি মানুষ আয়কর প্রদান করেন। এই সংখ্যাটি না বাড়াইলে উপায় নাই। কৃষিক্ষেত্রকে আয়করের আওতায় আনা তাহার একটি ধাপ। অসংগঠিত ক্ষেত্রেও যথাযথ আয়করের ব্যবস্থা করিতে হইবে। তাহার জন্য দরিদ্র মানুষের উপর খড়্গহস্ত হইবার প্রয়োজন নাই— যাঁহাদের কর দেওয়া উচিত, অথচ ফাঁকি দিতেছেন, তাঁহাদের ধরিতে পারিলেই যথেষ্ট। আর প্রয়োজন, কর পরিকাঠামোকে সরলতর করা। এক জন সাধারণ মানুষ যাহাতে অন্য কাহারও মুখাপেক্ষী না হইয়াই নিজের কর অনলাইনে জমা করিতে পারেন, ব্যবস্থাটি ততখানি সরল করা বিধেয়। ভারত সে পথে খানিক হাঁটিয়াছে, কিন্তু গন্তব্য এখনও বহু দূর।