ছবি: পিটিআই।
মানবাধিকার রক্ষায় কাজের জন্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নোবেল শান্তি পুরস্কারের তালিকায় স্থান পাইয়াছে। কিন্তু ভারতে তাহার স্থান হইল না। আর্থিক গোলযোগের অভিযোগে এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট সংস্থাটির সকল ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে লেনদেন বন্ধ করিল। ইহাতে দেশবাসীর উদ্বিগ্ন হইবার কারণ আছে। কিছু দিন পূর্বে সংস্থাটি দুইটি রিপোর্ট প্রকাশ করিয়াছে। একটির বিষয় দিল্লির সাম্প্রতিক দাঙ্গা। অপরটি কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ করিবার এক বৎসর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত। কোনওটিই কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে স্বস্তিকর নহে। দিল্লির দাঙ্গায় পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ করিয়াছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। জানাইয়াছে, দাঙ্গায় মুসলমানরাই বিপন্ন হইয়াছেন অধিক। কাশ্মীর সংক্রান্ত প্রতিবেদনেও সংবাদমাধ্যম এবং ইন্টারনেটের উপর নিয়ন্ত্রণের জন্য সমালোচিত হইয়াছিল কেন্দ্র। দেশে এবং বহির্বিশ্বে এই মূল্যায়ন প্রচার হইয়াছে। তাহার পরই সংস্থাটির বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত কেন্দ্রীয় সরকার— নেহাতই সমাপতন? সরকারি কর্তারা এমনই দাবি করিয়াছেন। কিন্তু দেশবাসী দেখিতেছে, এহেন ‘সমাপতন’-এর প্রাবল্য ক্রমবর্ধমান। কোনও সংবাদমাধ্যম কিংবা নাগরিক সংগঠন সরকারের সমালোচনা করিবার পরেই তাহার দফতরে ইডি অথবা আয়কর দফতরের তল্লাশি ঘটিয়া যায়।
উদ্বেগ আরও বাড়িতেছে এই সম্ভাবনায় যে, অসরকারি সংস্থার কাজ স্তব্ধ হইবার পালা সবে শুরু হইল। ভারতে যে অসরকারি সংস্থাগুলির আন্তর্জাতিক অনুদান পাইবার শর্তে এমন পরিবর্তন করিল সরকার, যে আর্থিক সহায়তার ধারাটি সঙ্কীর্ণ হইতে বাধ্য। সংসদের বাদল অধিবেশনে বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন (এফসিআরএ) সংশোধিত হইবার ফলে বৃহৎ সংগঠনগুলি আন্তর্জাতিক অনুদানের অংশ আর ক্ষুদ্র সংগঠনগুলিকে পাঠাইতে পারিবে না। প্রশাসনিক খরচ, অর্থাৎ কর্মীদের বেতন প্রভৃতির জন্য অনুদানের ২০ শতাংশের অধিক খরচ করিতে পারিবে না (পূর্বে এই সীমা ছিল ৫০ শতাংশ)। ইহার ফলে দেশের প্রত্যন্ত জেলাগুলিতে পরিবেশ সুরক্ষা, জীবিকার প্রশিক্ষণ, নারী অধিকার রক্ষা-সহ বিচিত্র নানা কর্মকাণ্ড স্তব্ধ হইবে। বহু দলিত, আদিবাসী, মহিলা কর্মী কাজ হারাইবেন। প্রশ্ন উঠিয়াছে, বিদেশি অনুদান ব্যবহার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করিবার মতো বিধিনিয়ম কি নাই? সেই পথে না হাঁটিয়া প্রধানমন্ত্রী সকল সংস্থার উপরে ‘সন্দেহজনক’ তকমা লাগাইলেন। আইন পরিবর্তনের ফলে অসরকারি ক্ষেত্রটিই সঙ্কুচিত হইবে, তাহার শক্তি ও স্বাতন্ত্র্য খর্ব হইবে।
বিদেশি অনুদানের হিসাবে স্বচ্ছতা লইয়া সরকারের এই অতিসক্রিয়তা ‘পিএম কেয়ার্স’ তহবিলে বিদেশি অনুদান, বা নির্বাচনী বন্ডে বিদেশি অর্থ গ্রহণের হিসাব জানাইবার ক্ষেত্রে দেখা যায় না। অতিমারির ফলে আর্থিক দুর্দশা যখন সকল সীমা ছাড়াইয়াছে, তখন বিদেশি অনুদানের পথ রুদ্ধ করা কেন এত জরুরি হইল, তাহাও প্রশ্ন বটে। তবে প্রধান আপত্তিটি নৈতিক। অসরকারি সংস্থাগুলি নাগরিক সমাজের অন্যতম স্তম্ভ, নাগরিক অধিকারের প্রহরী। অসরকারি সংস্থাগুলিকে হীনবল করিলে ভারতের নাগরিক সমাজ শক্তিহীন হইবে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সরকারের কর্তব্য, সন্দেহ নাই। কিন্তু রাশ টানিতে গিয়া গলায় ফাঁস লাগাইলে সরকারের অভিপ্রায় লইয়া সন্দেহ জাগিতে বাধ্য।