বর্ষা এসেছে বিলম্বে, দেশের একটা বড় অংশে খরার করাল ছায়া, চেন্নাইয়ে ভয়াবহ জলাভাব। এমন শিরোনামের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যাচ্ছে, প্রবল বর্ষণ হচ্ছে উত্তরবঙ্গ-সহ দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে। এ বার খবর হবে বন্যা নিয়ে। ভারতে আমরা যাঁরা জলসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কাজ করি তাঁরা অন্তত জানি, বন্যা আর খরা একই রোগের বহিঃপ্রকাশ। রোগটা হল বস্তাপচা, ভুল তথ্যে-ভরা নীতির প্রয়োগে দশকের পর দশক ধরে ভূমি, জল ও বাস্তুতন্ত্রের সর্বনাশ সাধন। এই সব ভ্রান্ত নীতির পরিণাম, আজকের জলবায়ু পরিবর্তন।
বিজ্ঞানী হিসেবে প্রায়ই এই প্রশ্নটা শুনতে হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের জেরেই কি এই জলসঙ্কট? হলে কতটা? উত্তরটা আপেক্ষিক। আমাদের হিমবাহগুলোকেই ধরা যাক। হিমালয়ে (ভারত, নেপাল, ভুটান মিলিয়ে) মোট কুড়ি হাজার বর্গকিলোমিটার হিমবাহ অঞ্চল আছে। শিল্প বিপ্লবের আগে বিশ্বের যা গড় তাপমাত্রা ছিল, তার চাইতে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের অধিক যেন না বাড়ে তাপমাত্রা, এই ছিল প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য। যদি কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে তা পূরণ করাও যায়, তা হলেও ২১০০ সালের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ হিমবাহ গলে যাবে। কিন্তু যে হারে কার্বন নিঃসরণ চলছে, তাতে লক্ষ্যপূরণ প্রায় অসম্ভব।
অতএব ২১০০ সালের মধ্যে গলে যাবে তিন-চতুর্থাংশ হিমবাহ।
একে কি রোখা যায়? একটা-দুটো দেশের পক্ষে অসম্ভব। তাই হিমালয়ধন্য দেশগুলোর উচিত চাপটা বজায় রাখা, যাতে বাকি দেশগুলো প্যারিস চুক্তির শর্ত রক্ষায় সজাগ থাকে। অতিবর্ষণ বা অতি তাপপ্রবাহের মতো চরম ঘটনাগুলিও সাধারণত জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণেই ঘটে। এগুলিও ক্রমশ বাড়ছে। বিজ্ঞানীরা এ ধরনের চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলোর উপরে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব আগের চাইতে এখন অনেক নিখুঁত ভাবে নির্ধারণ করতে পারছেন। জলবায়ুর পরিবর্তন প্রভাব ফেলে নদীর প্রবাহ ও জলধারার নির্গমনের উপরেও, হিমবাহ-গলা জল বা বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।
ভূগর্ভস্থ জলের উপরে অতিরিক্ত নির্ভরশীলতাই ভারতের জলসঙ্কটের প্রধান কারণ। ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহারের নিরিখে ভারত বিশ্বে এক নম্বর। দু’শো লক্ষ কুয়ো আর নলকূপের মাধ্যমে প্রতি বছর ২৫০ ঘনকিলোমিটার ভূগর্ভস্থ জল তুলে খরচ করে এ দেশ। বেশির ভাগ শহর, কৃষিও ব্যাপক ভাবে ভূগর্ভস্থ জলের উপর নির্ভরশীল। এ দেশে যে জলবায়ুর পরিবর্তনের ঝুঁকি ততটা চর্চিত নয়, তার কারণ তাপমাত্রা বা বৃষ্টিপাতের হেরফের হলেও ভূগর্ভের ‘অ্যাকুইফার’-এর (মাটির নীচে যে অংশে জল সঞ্চিত হয়) পরিবর্তন হতে অনেকটা বেশি সময় লাগে। তার মানে, ভূগর্ভের জলসঞ্চয় নিয়ে আমাদের এখনকার যে সঙ্কট, তা জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি ফলাফল নয়। কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদের কপালে দুঃখ আছে। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন এখন ভূগর্ভের জলভাণ্ডার ফের ভরে ওঠার (রিচার্জ) উপর প্রভাব ফেলছে। ভবিষ্যতে উত্তর ও পূর্ব ভারতের পলিমাটির স্তরের নীচে থাকা অ্যাকুইফারের উপরে তার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে। দক্ষিণ ভারতের শক্ত পাথুরে অ্যাকুইফারে (প্রতি বছর যা রিচার্জ হয়) ভূগর্ভস্থ জলসঞ্চয়ের উপরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এরই মধ্যে চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে জলসঙ্কটকে জুড়ে দেওয়ার একটা ঝুঁকি হল, তাতে নীতিপঙ্গুত্বের ঝুঁকি দেখা যায়। নীতি প্রণয়ন করেন যাঁরা, তাঁরা হাত তুলে দিয়ে বলতে পারেন, আমাদের তো কিছু করার নেই। এতে মস্ত বিপদ, কারণ আমাদের জলসমস্যার অনেকটাই ভুল নীতি বা পথভ্রষ্ট নীতির ফলাফল। আমাদের শহরগুলো কংক্রিটের জঙ্গল, ভূমি-ব্যবহার পরিকল্পনার তোয়াক্কা না করে বেড়ে উঠছে। প্রায় সব শহরেই জলাভূমি, পুকুর বুজিয়ে গড়ে উঠছে বাসভূমি। আর এতেই ভূগর্ভের জলসঞ্চয় কমে যাচ্ছে, চেন্নাইয়ের মতো জলসঙ্কট মাথাচাড়া দিচ্ছে। একই কারণে মুম্বইয়ের মতো শহর নিয়মিত ডুবছে শহুরে বন্যার জলে। সমাধান লুকিয়ে আছে উন্নত নগর পরিকল্পনা নীতির মধ্যে, জলাভূমিদের বাঁচিয়ে রাখায়, স্নান ও রান্নার জলের পুনর্ব্যবহারে, ঘরের চাহিদা মেটাতে বৃষ্টির জল সংরক্ষণে।
এ ক্ষেত্রে নাগরিক গোষ্ঠীগুলির কর্তব্য অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু সরকারি সহায়তা ও সুষ্ঠু নীতি না থাকলে এ সব কাজ করাও যাবে না। এমন নীতি চাই, যা পুরসভাগুলিকে জলাভূমি বাঁচাতে উৎসাহিত করবে, প্রাকৃতিক উপায়ে জলসঞ্চয় (রিচার্জ) হয় এমন জায়গাগুলিকে চিহ্নিত ও সংরক্ষিত করবে, শহরবাসী ও কলকারখানার মালিক-কর্মীদের উৎসাহিত করবে যাতে তাঁরা বৃষ্টির জল সঞ্চয় করেন ও বর্জ্য জল পুনর্ব্যবহারের বন্দোবস্ত করেন।
গ্রামের জলসঙ্কটও আসলে একটা নীতিজনিত সমস্যা, যার শুরু সবুজ বিপ্লবে। সবুজ বিপ্লবের প্রাণভোমরা ছিল তিনটি জিনিসে— উচ্চ ফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার ও সেচের বিস্তার। সেচের প্রয়োজনে মাটির তলার জল তুলতে বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছিল, আজও যা চালু আছে। লক্ষ্য ছিল, সামান্য মূল্যে প্রচুর ফসল উৎপাদন, যাতে শহরের দরিদ্র মানুষও কিনতে পারেন। আজ শহরবাসীর ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, কৃষকরাও অনেক বেশি কৃষিপণ্য উৎপাদন করছেন (সরকারি গুদামে অনেক সময়েই যা পচতে দেখা যায়) অথচ সেই ভর্তুকি আজও অনেক রাজ্যে চলছে। কৃষকদের থেকে বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুতের দাম চাইলে তাঁরা আরও দুর্দশায় পড়বেন। কিন্তু জল-(বিদ্যুৎ)শক্তি-কৃষিপণ্য, এই তিনটির যোগসূত্র কেমন হওয়া দরকার, তা ভাবতে হবে। এখন চাষিরা ধান, গম, আখের মতো ফসল ফলাচ্ছেন বেশি, যাতে জল লাগে প্রচুর কিন্তু পুষ্টি ততটা নেই। অন্য দিকে জোয়ার-বাজরার মতো পুষ্টিকর শস্য, যার উৎপাদনে জল লাগে অনেক কম, সেগুলো নিতান্ত অবহেলিত।
অতএব খাদ্য সংগ্রহের নীতিকে এমন ফসলকে উৎসাহ দিতে হবে যাতে কম জল লাগে। কৃষি শক্তি নীতি যেন ভূগর্ভস্থ জলের কম উত্তোলনকে উৎসাহিত করে, জল নীতি যেন জলসঞ্চয় ও জলবান্ধব কৃষিকে উৎসাহিত করে। কৃষকদের কি জলসঞ্চয়ে ভূমিকা নেই? আছে বইকি। একক বা গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে জল সঞ্চয় বা জল খরচের সুষ্ঠু ব্যবস্থা তাঁরা করতেই পারেন। কিন্তু সরকারের তরফে সুসংবদ্ধ নীতি প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত চাষির সদিচ্ছা, সেচের জল ব্যবহারে সতর্কতাও যথেষ্ট নয়।
ভারতের জল-ভবিষ্যৎ বর্তমান চিত্র স্বস্তিদায়ক নয়। আজ আমরা যা করব, তার প্রভাব পড়বে পরের প্রজন্মের উপরে। সবচেয়ে বড় কথা, জল নিয়ে নিজেরা সতর্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারকেও এমন নীতি প্রণয়নে বাধ্য করতে হবে, যা জলসংক্রান্ত বিবিধ নীতির জটিলতা কাটিয়ে সমন্বয় তৈরি করবে, উদ্যোগী হবে সুদূরপ্রসারী সমাধানে।
ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট, নয়াদিল্লিতে গবেষক