২০২০ সালে ভারতবাসীর গড় বয়স দাঁড়াইবে ২৯ বৎসর। দুনিয়ার তরুণতম জনগোষ্ঠীর একটি। স্বভাবতই এই তরুণ জনগোষ্ঠী কর্মসংস্থান চাহে। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে নরেন্দ্র মোদী তাঁহাদের এই চাহিদাটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়াছিলেন। বৎসরে দুই কোটি নূতন কর্মসংস্থান হইবে, তিনি ভরসা দিয়াছিলেন। সংখ্যাটি, তাঁহার আরও অনেক দাবির মতোই, অবাস্তব ছিল। কিন্তু কতখানি, তাঁহার শাসনের তিন বৎসর অতিক্রম করিয়া টের পাওয়া যাইতেছে। ২০১৫ সালে দেশে মোট নূতন কর্মসংস্থান হইয়াছিল এক লক্ষ পঞ্চান্ন হাজার জনের, ২০১৬ সালে সংখ্যাটি দাঁড়াইয়াছে দুই লক্ষ একত্রিশ হাজারে। অলীক প্রতিশ্রুতিটি আপাতত ভুলিয়া যাওয়া যাউক— অতীত বাস্তবের সহিত সংখ্যাটির ফারাক কতখানি? ২০০৯, ২০১০ এবং ২০১১ সালে ভারতে কর্মসংস্থান হইয়াছিল যথাক্রমে ১০.০৬ লক্ষ, ৮.৬৫ লক্ষ এবং ৯.৩ লক্ষ জনের। অর্থাৎ, ‘নীতিপঙ্গুত্বে ভোগা’ ইউপিএ-র আমলেও ভারতে যত কর্মপ্রার্থীর চাকুরি জুটিত, ‘বিকাশপুরুষ’ তাহার সিকিভাগের ব্যবস্থা করিয়া উঠিতে পারেন নাই।
অনস্বীকার্য, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির খানিক দায় আছে। বিশ্ব-ধনতন্ত্রের এক নূতন পর্ব চলিতেছে, যখন নব্যজাতীয়তাবাদ দেশের ভৌগোলিক সীমান্তে অর্থনীতির প্রাচীর খাড়়া করিতেছে, দরজা জানালা আঁটিয়া দিতেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে সময়ের বৃহত্তম বাস্তব, সে সময়ের প্রভাব দুনিয়ার অর্থনীতিতে পড়িবে বইকী। ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের উপর ছাঁটাইয়ের যে মেঘ ক্রমে কৃষ্ণতর হইতেছে, তাহার একটি বড় কারণ, অপেক্ষাকৃত কম দক্ষতার কাজের জন্য অপেক্ষাকৃত কম বেতনের ভারতীয় কর্মী নিয়োগ করিবার সুযোগ কমিয়াছে। স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি আসিয়াও কম দক্ষতার কর্মীদের চাকুরি লইয়া গিয়াছে। আশঙ্কা, আগামী তিন চার বৎসরে ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মরত অর্ধেক কর্মীরই আর কোনও প্রয়োজন থাকিবে না। তথ্যপ্রযুক্তির বাজার যে দ্রুততায় বদলাইতেছে, ভারতীয় সংস্থাগুলি তাহার সহিত তাল রাখিতে ব্যর্থ। ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাও উপযুক্ত দক্ষতার কর্মী তৈরি করিতে ব্যর্থ। ফলে, দেশে সংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত প্রতি চার জনের মধ্যে এক জন যে ক্ষেত্রে নিযুক্ত, সেই তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে অনিশ্চয়তা প্রবল।
ভারতে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, কতখানি? যে দেশের কর্মসংস্থানে সংগঠিত ক্ষেত্রের অবদান দশ শতাংশও নহে, সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিপদকে অনুপাতের অধিক গুরুত্ব দেওয়া অর্থহীন। ভারতের মূল সমস্যা, অসংগঠিত ক্ষেত্রে, ছোট উৎপাদন শিল্পে কর্মসংস্থানের প্রশ্নটি সরকারের নজরেই পড়ে না। চিনের ক্রমবর্ধমান মজুরির কারণে যখন সে দেশ হইতে উৎপাদন সংস্থাগুলি দেশান্তরে যাইবার সিদ্ধান্ত করে, ভারত সেই বাজার ধরিতে পারে নাই। অন্য দিকে, যে প্রথাগত ক্ষেত্রগুলিতে প্রভূত কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল, প্রযুক্তির আধুনিকীকরণের ফলে সেই সুযোগ সংকুচিত হইয়াছে। ক্ষুদ্র পুঁজিকে আন্তর্জাতিক পুঁজির সার্কিটে যোগ দেওয়ার পথ করিয়া দিতে হইলে সরকারের যে দায়িত্বগুলি থাকে, ভারতে তাহা পূরণ হয় নাই। এবং, এই পরিস্থিতির উপর গত বৎসর ৮ নভেম্বর নরেন্দ্র মোদী যাহা চাপাইয়া দিয়াছেন, তাহাকে শাকের আঁটি বলিবার উপায় নাই। শিল্পোৎপাদনের সূচক বলিতেছে, নোটবাতিলের ফল সংগঠিত উৎপাদন ক্ষেত্রের উপর মারাত্মক হইয়াছে। অর্থনীতির কাণ্ডজ্ঞান বলে, অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপর প্রভাব মারাত্মকতর। পরিসংখ্যানের হরেক মারপ্যাঁচে সরকার দেখাইতেই পারে যে নোটবদলে ক্ষতি হয় নাই। কিন্তু, তাহাতে বাস্তব বদলায় না। এবং, এই কথাটিও চাপা পড়ে না যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নহে, ভারতে কর্মসংস্থানের এই শ্লথগতির জন্য সরকারই দায়ী।