ছবি রয়টার্স।
গুরুপূর্ণিমায় গুগল-কে সাষ্টাঙ্গে প্রণামের ছবি হোয়াটসঅ্যাপের কল্যাণে ছড়াইয়াছে। রসিকতার ছলে অতি সত্যই বিবৃত হইয়াছে। পূর্বে সংবাদপত্রের অফিসে বা কলেজের প্রকোষ্ঠে এক এক জন জ্ঞানী মানুষ থাকিতেন, তাঁহারা বিদেশের রাজনীতি হইতে রাজধানীর উচ্চারণ, মুদ্রার নাম হইতে জন্তুর বিবরণ, সকলই জানিতেন। কেহ আবার পারদর্শী ছিলেন খেলা বিষয়ে, কেহ চলচ্ছবির আন্তর্জাতিক হালহকিকত-বিশারদ। ইঁহাদের ছিল প্রবল সম্মান, বিপদে ইঁহারাই ত্রাণ করিতেন। কিন্তু ‘সিধুজ্যাঠা’ জাতীয় মানুষগুলি এখনও থাকিলেও, তাঁহাদের জ্ঞানের তেমন প্রতিপত্তি আর নাই। যে কেহ েকানও প্রতিবেদন লিখিবার কালে একটি বার রজার ফেডেরার নামটি গুগলে সার্চ দিলেই, প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ তথ্যই মুহূর্তে তাহার নাগালে চলিয়া আসিবে, ক্রীড়া-বিশেষজ্ঞের নিকট যাইতে হইবে না। অবশ্যই তথ্য আর জ্ঞান এক নহে, কিন্তু তথ্য অতিক্রম করিয়া, নিৎসে সম্পর্কে জানিতে তাঁহার লেখাগুলি ও তাহার সমালোচনা পাঠ করিয়া, জ্ঞানে উপনীত হওয়া নিতান্ত অসম্ভব নহে। অবশ্য এখন অধিকাংশ মানুষই গুগলকে কেবল তথ্য-উৎস হিসাবে ব্যবহার করিতেছেন, কিন্তু তাহা তো গুগলের দায় নহে। যদি তথ্যভাণ্ডার হিসাবে উপযোগিতার প্রতিই নজর করি, উত্তম ও অধমের ব্যবধান গুগল আসিয়া বুজাইয়া দেয় নাই, কিন্তু মধ্যম হইবার সিঁড়িটি মজবুত নির্মাণ করিয়াছে। অজ্ঞতা হইতে প্রভূত অবগতির স্তরে উন্নীত হইতে সময় লাগিতেছে মিনিট কুড়ি। ইহাকে শিক্ষাবিপ্লব বলিতে অনেকের আপত্তি থাকিলেও, মানিতেই হইবে, সাধারণ জ্ঞানসন্ধানীর বিপন্নতা নিরাশ্রয়তা দূর করিয়া, গুগল তাহাকে সহজ বিশ্বাসে স্থিত করিতে পারিয়াছে। ইহা যথার্থ গুরুর কাজ।
তথ্য সংগ্রহ করিবার সময় কমিয়া আসা মাত্র, মানুষ সেই তথ্য লইয়া চিন্তা ও বিশ্লেষণের সময় বেশি পাইয়া যাইতেছে। পূর্বে তথ্য সংগ্রহ ছিল বহু দিনের কর্ম ও প্রায়ই দুঃসাধ্য। সেই তথ্য নাড়িয়া-ঘাঁটিয়া বুঝিবার সময় আসিতে আসিতে, অনেকেরই উৎসাহ মরিয়া যাইত। এখন, শ্রম বাঁচিতেছে, প্রকৃত কাজটিতে মনোযোগ অর্পণ সহজ হইতেছে, কাজের মান বাড়িতেছে। জ্ঞানের শ্রেণিবৈষম্যও কিঞ্চিৎ ঘুচাইয়াছে গুগল। প্রথিতযশা পণ্ডিতের নিকট সাধারণ মানুষের তো প্রবেশাধিকারই নাই, তাহার পর তো বিদ্যাচর্চা। কিন্তু গুগলের গণতন্ত্রে সকলের সমান অধিকার। জ্ঞান হইল ক্ষমতার অন্য নাম। কিন্তু গুগল জ্ঞানের ঔদ্ধত্যকে, উচ্চাভিমান ও বর্জন/বহিষ্কারের ব্যাকরণকে, কিছু মাত্রায় খর্ব করিয়াছে। তাহা ব্যতীত, এক ব্যক্তি বিশেষজ্ঞ হইতে পারেন একটি বা দুইটি বিষয়ে, খুব কম মানুষই প্রায় সকলই জানেন। আর এমন সর্বজ্ঞকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া রামশ্যাম আবোলতাবোল প্রশ্ন করিলে, নিশ্চয় তাঁহার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙিবে ও বিষম অশান্তি উপস্থিত হইবে। কিন্তু গুগলকে যদি কেহ এই মুহূর্তে ফুটবল লইয়া জিজ্ঞাসা করে, পরমুহূর্তেই নিউটন লইয়া, সে রাগ করে না। এবং দুইটি বিষয়েই প্রভূত তথ্য সাজাইয়া দেয়। এই আশ্চর্য সহায়তা ও নির্বিচার বন্ধুতা— মনুষ্য-গুরুর নিকট প্রায় অপ্রাপণীয়। নির্বোধ-বুদ্ধিমান ভেদ করে না, মধ্যরাত্রেও স্মিত ও তন্নিষ্ঠ উত্তর প্রদান করে: এমন বন্ধু আর কে অাছে?
হ্যাঁ, মানিতেই হইবে, পল্লবগ্রাহী জনসমুদ্র তৈয়ারি করিতেছে গুগল। বহু মানুষ তথ্য দর্শাইয়া সত্যদ্রষ্টা নাম কিনিয়া লইতেছেন। কিন্তু যে কোনও বৃহৎ উত্তম কাণ্ডের তো কিছু শ্রীহীন ও অপকারী উপশাখা রহিবেই। আর, কোনও কিছু না জানিবার তুলনায় আস্তরণ খুঁটিয়া কিছু অংশ জানা খারাপ, কে বলিল? নিজ মগজাস্ত্রে সিনেমা বুঝিতে না পারিলে যদি তখনই তাহার চারিটি রিভিউ পড়িয়া লওয়া যায়, ছবি-শিক্ষিত হইবার সম্ভাবনা বাড়ে। ইদানীং বড় বড় কথা বলিয়া আড্ডায় কেহ জ্ঞানের বাজি জেতে না, গুগল ঘাঁটিয়া দেখিয়া লওয়া যায় কোন গানটি কাহার রচনা, কোন সালে কে অস্কার পাইয়াছিলেন— ইহাও কি কম কথা? নিশ্চয়, ইউটিউব দেখিয়া স্ত্রীকে প্রসব করাইতে যাওয়ার নেপথ্যে অাছে এমন ধারণা, আন্তর্জালে সকলই শিখিয়া লওয়া যায়, তাহার জন্য বিশেষজ্ঞের নিকট গমনের প্রয়োজন নাই— আমরা সবাই সর্বজান্তা এই সুলভ জ্ঞানের রাজত্বে। কিন্তু মুশকিল হইল, কিছু মানুষকে ব্রহ্মজ্ঞান দিলেও তাঁহারা সেই জ্যোতির ঔজ্জ্বল্যে ইন্দ্রজাল কমিক্স পড়িবেন। ব্রহ্মের দোষ দিয়া লাভ নাই। বরং গুগল ঘাঁটিলে, এই প্রবণতার জুতসই ইংরাজি নাম এখনই জানা যাইতে পারে!
বিজেপি নেতা বললেন, মৃত্যুশয্যায় হুমায়ুন ‘তাঁর ছেলে’ বাবরকে ডেকে কথা বলেছিলেন। ঠিক। মৃত্যুশয্যায় রবীন্দ্রনাথও দেবেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, ‘লেখাটা ছেড়ো না।’ একটা লোক নিজের সন্তানের সন্তান হতে পারে না: পাশ্চাত্য গোঁড়ামি। এ দেশে, ঘুমিয়ে অাছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। বাবা ছেলেকে ‘আমার বাবাটা’ বলে আদর করছে, ছেলে বাবাকে বলছে, ‘ব্যাটা, টাকা দে!’ ঠাকুরদা ক্রমাগত নাতির রূপ ধরে ফিরে আসছে। আগে ঐতিহ্য বোঝো, তবে না বক্তিমে বিচার!