শিশু জন্মের পরেই মাতৃদুগ্ধ পান করুক, চলুক দীর্ঘদিন

অগস্টের প্রথম সপ্তাহ হল ‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধপান সপ্তাহ’। বাচ্চাকে মাতৃদুগ্ধ পান করানো নিয়ে এখনও প্রচুর ভ্রান্ত ধারণা, অন্ধ বিশ্বাস রয়ে গিয়েছে। অখনও বহু শিশু তার প্রাপ্য পুষ্টি থেকে বঞ্চিত। লিখছেন আজিজুর রহমানস্তন্যদাত্রী মা’র পুষ্টি ঠিকমতো হলে যেমন প্রসবের পরে শরীরের ক্ষয়পূরণও হয়, তেমনই দুধ নিঃসরণেও কোনও সমস্যা হয় না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৯ ০২:২০
Share:

মাতৃদুগ্ধ পান সচেতনতায় মহিলাদের মিছিল। ফাইল চিত্র

মাতৃদুগ্ধের বিকল্প নেই। নবজাতকের পুষ্টি, বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য যাবতীয় প্রয়োজন মায়ের দুধ থেকে পাওয়া যায়। তাই জন্মের পরে, যত দ্রুত সম্ভব নবজাতককে মায়ের দুধ পান করানো দরকার। শিশুর জন্মের পরে, প্রথম ঈষৎ হলুদ বর্ণের যে গাঢ় দুধ নিঃসৃত হয়, তাকে ‘কলোস্ট্রাম’ বলা হয়। ‘কলোস্ট্রাম’ নবজাতকের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী। কারণ, এতে পুষ্টিগুণ ছাড়াও আরও বিভিন্ন ধরনের ‘ইমিউনোগ্লোবিউলিন’ থাকে, যা নবজাতককে ভবিষ্যতে কয়েকটি রোগ থেকে মুক্ত রাখে। এ সমস্ত বিষয় মাথায় রেখেই স্তন্যপানে সচেতনতা আরও বাড়াতে অগস্টের প্রথম সপ্তাহটি ‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধপান সপ্তাহ’ হিসেবে পালিত হয়।

Advertisement

আমাদের দেশে বহু মা অপুষ্টিতে ভোগেন। গর্ভাবস্থায় নিজের ও শিশুর পুষ্টির বাড়তি চাহিদার জন্য অপুষ্টির পরিমাণ আরও বাড়ে। তবু দেখা গিয়েছে, আমাদের দেশের মায়েরা সন্তান জন্মের পরে, প্রায় এক বছর পর্যন্ত ৪০০-৬০০ মিলিলিটার দুধ দিতে পারেন। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোগ্রাম ওজনের জন্য ১০০ কিলোক্যালরি শক্তির প্রয়োজন হয়। আর মায়ের প্রতি ১০০ মিলিলিটার দুধে ৭০ কিলোক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। সেই হিসেবে তিন কিলোগ্রাম ওজনের কোনও শিশু যদি দৈনিক ৪০০-৫০০ মিলিলিটার দুধ পান করতে পারে, তা হলে তার পুষ্টির চাহিদা মেটে। মায়ের বুকের দুধ সহজপাচ্য এবং যে তাপমাত্রায় পান করানো দরকার, সেই তাপমাত্রাতেই পাওয়া যায়। এটি নিরাপদ এবং জীবাণুমুক্ত। বুকের দুধ খাওয়ানোও মায়ের ক্ষেত্রেও সমান উপকারী। এতে মায়ের প্রসব পরবর্তী রজস্রাব হয় না। গর্ভ নিরোধেরও কাজ করে।

ছ’মাস বয়স পর্যন্ত সমস্ত শিশুকে কেবলমাত্র বুকের দুধেই খাওয়ানো দরকার। এমনকি, এ সময়ে জলের দরকার হয় না। ছ’মাসের পর থেকে পরিপূরক আহারের সঙ্গে সঙ্গে কমপক্ষে দু’বছর পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত। এ ক্ষেত্রে পরিবারে সচরাচর সবাই যা খান, তাই বাচ্চাকে ধীরে ধীরে অভ্যাস করানো দরকার। তা হলে কোনও ভাবেই শিশুটি অপুষ্টির শিকার হবে না। নামী-দামি কোম্পানির ‘প্রসেস্ড’ খাদ্য দেওয়ার প্রবণতা কমাতে হবে।

Advertisement

তবে দুর্ভাগ্যের বিষয়, বুকের দুধ পান করানো নিয়েও প্রচুর ভ্রান্ত ধারণা, অন্ধ বিশ্বাস, চিরাচরিত প্রথা, কুসংস্কার সমাজে রয়ে গিয়েছে। এখনও সব ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে শিশুকে বুকের দুধ দেওয়া হয় না। কয়েকবছর আগেও দেখেছি, জন্মের পরপরই বাচ্চাকে বুকের দুধ দেওয়ার আগে গ্লুকোজের জল, মিছরির জল, মধু ইত্যাদি দেওয়ার চল ছিল। তবে জানা দরকার যে, এ সব জিনিস পরিপাক করার মতো অবস্থায় তখন শিশুটি থাকে না। ফলে, বদহজমের সঙ্গে রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা বাড়ে। তা ছাড়া, অনেক পরিবারে মায়ের ‘কলোস্ট্রাম’ নিঃসৃত হলেও তা বাচ্চাকে দেওয়া হত না। বলা হত, তা নাকি অত্যন্ত গুরুপাক। বাচ্চার পক্ষে হজম করা সম্ভব নয়।

পাশাপাশি, প্রসবের পরে, প্রথম সাত দিন মাকে ভারী খাবার দেওয়া হত না। কেবল চিঁড়ে ভাজা ও গরম জল খেয়ে আধাপেটা থাকতে হত। ফলে, বুকের দুধ কমে যেত আর পরিণামে বাচ্চাকে গরুর দুধ, সাবু, বার্লি, কৌটোর দুধ, এ সব দেওয়া হয়। এই সব ভ্রান্ত ধারণার জন্যই শিশুর জন্মের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই সর্বনাশ ডেকে আনা হত। ধাক্কাটা বেশি লাগত কম ওজন বা খুব কম ওজনের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম সপ্তাহের মধ্যে নবজাতকের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ত্রুটিপূর্ণ খাওয়া-দাওয়া।

স্তন্যদাত্রী মা’র পুষ্টি ঠিকমতো হলে যেমন প্রসবের পরে শরীরের ক্ষয়পূরণও হয়, তেমনই দুধ নিঃসরণেও কোনও সমস্যা হয় না। কিন্তু ভ্রান্ত ধারণার বশে এখানেও কার্পণ্য করা হয়। ধারণাটি হল, মা অতিরিক্ত খাবার খেলে, মায়ের সঙ্গে সঙ্গে শিশুরও বদহজম হবে। কারণ, সে মায়ের দুধ খায়। তাই প্রসূতিকে কোনও আমিষ জাতীয় খাবার সচরাচর দেওয়া হত না। আবার, কোনও কারণে শিশুর পাতলা পায়খানা, জ্বর, কাশি, বমি, পেট ফাঁপা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিলে মাকেই দোষারোপ করা হত। ‘লোভী’ বলে গঞ্জনাও সহ্য করতে হয়েছে, এমনও দেখা গিয়েছে। বাচ্চার জ্বর, কাশি, পেট খারাপ যা-ই হোক না কেন, তার সঙ্গে সঙ্গে মায়েরও খাবারে কোপ পড়ত। যত দিন পর্যন্ত বাচ্চাটি বুকের দুধ খেত, তত দিন এই নিয়ন্ত্রণ চলত। আর এর ফলে, আখেরে শিশু ও মা, উভয়েরই স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়ত।

তবে এই পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলেছে। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলারা, যাঁরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ সব বিধিনিষেধ আরোপ করতেন, তাঁরা এ সব ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্ত হয়েছেন। তবুও মায়ের দুধের উপকারিতা, পুষ্টিগুণ ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে গর্ভকালীন অবস্থায় মা-সহ পরিবারের সকলকে সম্যক ভাবে বোঝানো দরকার। শিশু জন্মানো মাত্রই যেন বুকের দুধ দেওয়া হয় এবং যত দীর্ঘদিন সম্ভব তা পান করানো সম্ভব হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্য সহযোগী কর্মী যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নিবিড় স্বাস্থ্যশিক্ষা কর্মসূচি লাগাতার চালালে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে।

লেখক প্রাক্তন মাতৃত্ব ও শিশুকল্যাণ আধিকারিক, পুরুলিয়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement