২০১৯-এর ভারত বলছে: ‘ইট’স ন্যাশনালিজ়ম, স্টুপিড’!

যা ভেবেছি, যা ভাবতে হবে

দ্বিতীয় দফার পর টিভির পর্দায় নরেন্দ্র মোদীর শরীরী-ভাষা বা বডি ল্যাঙ্গোয়েজে দুর্ভাবনার ভাল রকম ছাপ পড়েছিল। বিজেপির অভ্যন্তর থেকেও উদ্বেগের নানা ইঙ্গিত ভেসে এসেছে তখন। 

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ৩১ মে ২০১৯ ০০:০১
Share:

সতেরো নম্বর লোকসভা নির্বাচন নিয়ে এ দেশের ইতিহাস অনেক দিন আলোচনা চালাবে বলে মনে হচ্ছে। এক দিক দিয়ে, এমন স্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন ফলাফল কোনও জাতীয় নির্বাচনে দেখতে পাওয়া দুর্লভ। ভারতের প্রায় সমস্ত রকম অঞ্চল, গোষ্ঠী, সমাজ এই নির্বাচনে কমবেশি একই সুরে কথা বলেছে, দক্ষিণের একটা অংশ বাদ দিয়ে, ‘টাইম’ পত্রিকা যাকে বলেছে ‘একক ভারতের উত্থান’! এত বড় দেশের প্রেক্ষিতে, এ এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি ভাসছে উত্তুঙ্গ আত্মসন্তোষে। অন্য একটা দিক দিয়ে কিন্তু, ফলাফলের মধ্যে লুকিয়ে রইল বেশ বড় কিছু ধাঁধা। কী ভাবে, কবে সেই ধাঁধার সমাধান মিলবে? আদৌ মিলবে কি? বিজেপিও কি দেখেশুনে একটা বিস্ময় বোধ করছে না?

Advertisement

প্রশ্নটা উঠছে এই জন্য যে, সপ্তম দফার পর যে দলটি বিপুল জয়ের আনন্দে ভাসবে, প্রথম কয়েক দফার পরও কিন্তু সেই দলের অভ্যন্তরে রীতিমতো দুশ্চিন্তা ছিল। দ্বিতীয় দফার পর টিভির পর্দায় নরেন্দ্র মোদীর শরীরী-ভাষা বা বডি ল্যাঙ্গোয়েজে দুর্ভাবনার ভাল রকম ছাপ পড়েছিল। বিজেপির অভ্যন্তর থেকেও উদ্বেগের নানা ইঙ্গিত ভেসে এসেছে তখন।

মনে করা যাক সময়টা। প্রথম পর্বে ৯১টি আসনে ভোট হয় ১১ এপ্রিল। উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও মহারাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে ভোট হয় সেই দফায়। ‘হিন্দু’ ও ‘ফ্রন্টলাইন’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বিজেপি ও এনডিএ নিজেরা আন্দাজ করে দেখে, ২৫টির বেশি আসনে জয়ের আশা নেই। ২৫?— এ তো ২০১৪-এর চেয়ে অনেক কম! তা হলে কি বালাকোট, পাকিস্তান, চৌকিদার, পরিবারতন্ত্র ইত্যাদি তেমন কাজ করল না? ১৬ এপ্রিল দিল্লির বিজেপি হেডকোয়ার্টার্স থেকে প্রস্তাব: ‘ম্যায় ভি চৌকিদার হৈ’ এবং ‘মোদী হৈ তো মুমকিন হৈ’ ইত্যাদির সঙ্গে এখনই একটা নতুন স্লোগান দরকার: ‘কাম রুকে না, দেশ ঝুকে না’! বার বার স্লোগান-পরিবর্তন নিয়ে কানপুরের আরএসএস কর্মীরা নাকি প্রকাশ্যেই অসন্তোষ জানান।

Advertisement

কিন্তু হঠাৎ ‘কাম’-এর কথা? অর্থনীতির অঙ্গনে যে হেতু গত বারের সরকারের রেজ়াল্ট ভাল নয়, তাই অর্থনৈতিক ‘অচ্ছে দিন’-এর পাশ কাটিয়ে ‘বালাকোট জাতীয়তাবাদ’ আর ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম’-এর হাত ধরেই এই বারের ভোটটা পার করারই তো সিদ্ধান্ত ছিল প্রথমে? তবে কি ওই প্রাথমিক অবস্থান থেকে সরে আসার চেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে বিজেপির পুনর্বিবেচনাকে?

সম্ভবত, কংগ্রেসের ‘ন্যায়’ ও ন্যূনতম সর্বজনীন আয় (ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম)-এর প্রস্তাবেই সঙ্কট দেখছিল বিজেপি। ‘ন্যায়’ নিয়ে প্রথম থেকেই বিজেপি রক্ষণাত্মক। রাহুলের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং নেহরু-কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার যে প্রধানমন্ত্রীর বৈশিষ্ট্য, তাঁকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ‘ন্যায়’-এর অপব্যাখ্যা দিতে দেখেছি আমরা। তাঁকে বলতে হচ্ছিল যে, বিজেপি এত দিন অর্থনীতির জন্য যা করেছে, সেটাই যথেষ্ট, তার জোরেই মানুষ পদ্মের বোতাম টিপবেন। অরুণ জেটলি মার্চের শেষ সপ্তাহে ‘ন্যায়’-প্রস্তাবকে ‘ধাপ্পাবাজি’ বলেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে কিন্তু আবার ‘ন্যায়’-বিরোধী প্রচার জোর পায়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গয়াল ঘোষণা করেন— এত বড় দেশের জন্য অর্থনৈতিক ভাবে কিছু করতে হলে চাই একটা বড় মাপের পরিকল্পনা, যেটা নাকি বিজেপি ইতিমধ্যেই পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য ঠিক করে ফেলেছে। ‘‘বিজেপি সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরবর্তী পাঁচ বছরে ১০০ লক্ষ কোটি টাকা দেশের পরিকাঠামোতে লগ্নি করা হবে, এবং মাইনে ও মজুরি বাবদ তার এক-তৃতীয়াংশের মতো ব্যয় করা যাবে’’: গয়াল (১৪ এপ্রিল)। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক ক্ষোভটা মানুষের মনে ঠিক কতখানি জমেছে, বিজেপির মধ্যে এই পর্বেও সেটা নিয়ে অস্বস্তি ছিল বিরাট।

সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল, মূল ফোকাস বিজেপির বদলে ‘নরেন্দ্র মোদী’র উপর নিয়ে আসা। এই বারের নির্বাচন যে আসলে মোদীর নামে গণভোট, সংসদীয় নির্বাচনের বদলে প্রায় প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেম-এ ভোটের প্রবণতা যে এ বার দেখা গেল— চতুর্দিকে এই সব বিশ্লেষণ চলছে। নিশ্চয়ই আমরা এ প্রসঙ্গে মনে রাখছি যে অক্ষয়কুমারের সঙ্গে মোদীর বিখ্যাত সাক্ষাৎকারটি কিন্তু হয়েছিল ২৪ এপ্রিলে, তার আগে নয়। তারিখটা হয়তো বলে দিচ্ছে যে মোদীর মুখ দিয়ে সরাসরি কিছু কথা বলানোর প্রয়োজনবোধ বেশ তীব্র হয়ে উঠেছিল সে সময়টায়।

এ সব কিছুর ভেতরে যে মূল কথাটা থেকে যায়, তা হল— ভারত যে কতটাই এক সুরে এক স্বরে ভোট দেবে, বিজেপি নেতারাও সেটা আন্দাজ করতে পারেননি। (যে প্রথম রাউন্ডে তাঁরা ২৫টি আসনের কথা ভেবেছিলেন, তাতে শেষ পর্যন্ত আসন দাঁড়ায় ৩৮।) শেষ দিকে অমিত শাহ-সহ সাক্ষাৎকারে মোদীর মুখ চুন করে বসে থাকা, কিংবা তৎপরবর্তী কেদার-কৌতুক— সবই তাঁদের মানসিক অশান্তির পরিচায়ক। গোড়ার কথাটায় ফিরে যাই আবার: অকারণেই বিজেপি তার সমর্থনের পরিমাণ নিয়ে আগাগোড়া অশান্তিতে থেকেছে।

স্বাভাবিক। কেউ কী করে বুঝবে যে, অনেক দিন পর, এই বারের ভোটেই ঘটে যাবে একটা বিরাট ‘প্যারাডাইম চেঞ্জ’ বা বৃহৎ প্রকারগত পরিবর্তন? প্রমাণ করবে যে, ভারতের সমাজে আজও একই সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়-নির্ভর শ্রেণি-রাজনীতি ও সামাজিক বিভাজন-নির্ভর ‘আইডেন্টিটি’ বা সত্তার রাজনীতিকে ভেঙে ফেলা যায়, ও তৈরি করা যায় একটা বিকল্প ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’? ২০১৪ সালের চেয়ে অনেকটাই যে আলাদা ২০১৯-এর এই মহা-আখ্যান! ২০১৪ সালে ছিল স্থিতাবস্থাবিরোধিতার (অ্যান্টি-ইনকামবেন্সি) চাপ, এবং তাকে তীব্র করে তোলার মতো অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন-প্রদর্শন— মোদীর ‘অচ্ছে দিন’। আর এ বার? আইডেন্টিটির সঙ্গে অর্থনৈতিক ‘অচ্ছে দিন’ও গুরুত্ব পেল না।

অদ্ভুতই বলতে হবে। শ্রেণি-রাজনীতিকে অনেকটা পরাস্ত করে ‘আইডেন্টিটি’র রাজনীতি এ দেশে তার শিকড় ছড়িয়েছে বহু দিনই। আশির দশক থেকে ধর্ম, জাত, জাতের মধ্যেকার ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠী বিভাজন, আঞ্চলিকতা, এই সব আইডেন্টিটি ভারতের রাজনীতির মূল চালিকা হতে শুরু করেছে। সমাজতাত্ত্বিকরা বলেছিলেন, গণতন্ত্রের বিস্তারের সঙ্গে গণতন্ত্রের এই রূপটি অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত। বলেছিলেন, ভারতের মতো ঐতিহ্য-শাসিত ও ঔপনিবেশিক আধুনিকতায় দীক্ষিত গণতন্ত্রের এটাই ভবিতব্য— যত বেশি তা তৃণমূল-স্তরে বিস্তৃত হবে, ততই আইডেন্টিটি নামক বাহনের পিঠে চড়তে শুরু করবে। পেরি অ্যান্ডারসনের বইতে (দি ইন্ডিয়ান আইডিয়োলজি) ভারতীয় গণতন্ত্রের তীব্র সমালোচনাও বলেছিল ‘সেন্ট্রালিটি অব কাস্ট’-এর কথা, মনে করেছিল যে, গণতন্ত্রের প্রক্রিয়ায় ক্রমশ সমাজের ভেতরকার গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠীগুলিই জোর পায়। প্রশ্ন উঠেছিল যে, এই ফ্র্যাগমেন্টেশন বা খণ্ডীকরণকে অগ্রাহ্য করে আদৌ কোনও অর্থবোধক গণতন্ত্র তৈরি করা সম্ভব কি না। অথচ, এই বারের ভোট-ফলাফল হয়তো অন্য কথাই বলছে। হিন্দুত্ববাদ এ বারে সম্ভবত শ্রেণি-রাজনীতির সঙ্গে আইডেন্টিটি রাজনীতিকেও ভেঙে ফেলেছে অনেকখানি। অন্তত আপাতদৃষ্টিতে তা-ই মনে হয়।

‘আপাত’দৃষ্টিই সবচেয়ে গভীর দৃষ্টি হতে পারে না। সুতরাং এ নিয়ে ভাবনার চর্চা চলবে অনেক দিন। সত্যিই আইডেন্টিটি ‘ভেঙেচুরে’ হিন্দুত্বের এই বিরাট মোনোলিথ বা একীভূত হিন্দু-জাতীয়তা তৈরি হল কি না, না কি, আইডেন্টিটিগুলো সব নিজ নিজ খণ্ড-আকার ‘অক্ষত’ রেখে সাময়িক ভাবে একত্র হল, আবার যথাসময়ে তারা মঞ্চের দখল নেবে— এ সব এখনও অস্পষ্ট। কিন্তু অস্পষ্টতা দূর করতে যে আবার নতুন বিশ্লেষণে বসতে হবে, সন্দেহ নেই।

লিবারালদের, অর্থাৎ আমাদের, অসীম দুর্গতি। আমরা আইডেন্টিটি পলিটিকস-র মধ্যেও দেখেছি মানসিক পশ্চাৎপদতার ছাপ। ঐতিহ্যকে আঁকড়ে রেখে গণতন্ত্র থেকে যা-কিছু লুটেপুটে নেওয়ার প্রবণতা। আবার সত্তা-রাজনীতি যখন ধ্বস্ত হল হিন্দুত্ব-শিলার আঘাতে, তখন তাতে আরও বড় পশ্চাৎপদতার আক্রমণ দেখে আমরা আঁতকে উঠছি। এত দিন মার্ক্সবাদীরা বলেছেন, সত্তা-পরিচয়ের সংঘাত আসলে শ্রেণিসংঘাতেরই রকমফের, সুদীপ্ত কবিরাজ-এর ভাষায় ‘দ্য ক্লাস-এফেক্ট অব কাস্ট’। অামরা ভেবেছি, শেষ কথা বলবে ‘মানুষ’— তাদের রোজগারপাতির গোড়ার কথাগুলো ভেবেচিন্তে। ওই যে চাষিরা মিছিল করছে, ওই যে দলিতরা তাদের জীবিকায় ঘা পড়ছে বলে ফুঁসে উঠছে, ওই যে ছাত্রছাত্রীরা চাকরি না পেয়ে বিক্ষোভমিছিলে শামিল হচ্ছে, ওই যে সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত নিপীড়িত হচ্ছে, এরাই প্রকৃত ভারত— ‘অন্য ভারত’-এর হয়ে এরাই কথা বলবে। বিজেপিও যে এই ভাবনাবলয়ের বাইরে ছিল না, নির্বাচনী ঋতুর দ্বিধাদ্বন্দ্বই সেটা বলে দেয়। কিন্তু, না, সবাই ভুল ভাবছিলাম আমরা। এই ভোট বলে দিল, অর্থনৈতিক ও ব্যবহারিক দুঃখ-কষ্ট ভেদ করে ঢুকে যেতে পারে ধর্মবাদ ও রাষ্ট্রবাদের ব্রহ্মাস্ত্র, একটা উদ্ধত ও আগ্রাসী হিন্দু রাষ্ট্রের লোভ।

এই ভারত এখন আমাদের নতুন করে ভাবাবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের নব্বই দশকের গোড়ায় উচ্চারিত বাক্যটা আমাদের এত দিন খুব পছন্দের ছিল, ‘ইট’স দি ইকনমি, স্টুপিড!’ ২০১৯-এর ভোটের ভারত বোধ হয় আজ আমাদের ব্যঙ্গ করে বলছে: ‘ইট’স ন্যাশনালিজ়ম, স্টুপিড’!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement