জাতপাতের বিভেদের সঙ্গে, বাড়তে থাকা এই আর্থিক বৈষম্যও কিন্তু বেশ চিন্তারই।
ধরুন আপনার জন্মদিন। গত বছরের তুলনায় এ বারের কেকটা কিন্তু অনেক বড়। আপনি কাটলেন। আপনার ভাগটাও পেলেন। কিন্তু গত বছরের তুলনায় আপনাকে জিভে ছুইয়ে দিয়ে বাকিটা অন্যদের পেটেই যেতে দিতে হল। এ বারে কোভিডের কারণে আমন্ত্রিত কম। তাই কেকের ভাগের মাথাপিছু অঙ্কটাও বেশ বড়। কিন্তু আপনার ডায়াবিটিস। উপলক্ষ আপনি হলেও তাই আপনার ভাগে পড়ল জিভ ছোঁয়ানোর সুযোগ। কেকের ওজন এক থাকলেও কিন্তু অন্যদের ভাগে এ বার বেশি থাকত। কারণ আপনার ভাগটা অন্যদের জুটত। এ বার তো আরও বেশি।
জিডিপি-র অঙ্কটাও এই রকম। মাথাপিছু হিসাবে বোঝা যায় না আপনার ভাগটা অন্যের জুটল কি না। তা দেখতে আরও কিছু তথ্যে চোখ বোলাতে হয়। সে অঙ্কে যাওয়ার আগে প্রথম অঙ্কটা বুঝে নিই। সরকারি তথ্য বলছে চলতি বছরে কোভিডের গুঁতোয় ব্যবসাপাতি বন্ধ থাকায় জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি সংকোচন হবে ৯.৫ শতাংশ! এটা এখন আমাদের মুখস্থ। ফেসবুক থেকে শুরু করে সব জায়গায় সবাই আমরা হায় হায় করে চলেছি। অনেকেই, যাঁরা বেশি বুদ্ধিমান, তাঁরা বলছেন, ‘দেশের আয়ে ওঠানামা তো হয়েই থাকে। এই নিয়ে এত লাফালাফির কি আছে? তার উপরে কোভিড!’
হায়হায়-এর দল আর বুদ্ধিমানের দল দু’জনেই কি ঠিক হতে পারেন? হয়ত। আসলে হয়ত দুজনেই ঠিক তাঁদের জায়গা থেকে। যাঁরা বলছেন চক্রবৎ পরিবর্তনের কথা তাঁরা হয়ত ওই কেক বেশি পাওয়ার দলে। আর হায়হায় করার দল আসলে ডায়াবেটিসের রোগি! কিন্তু তলিয়ে না দেখলে তো সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল। তবে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে দুজনেই ঠিক। একদল সব পেয়ে আর আর এক দল প্রায় সব হারিয়েই।
দেশের সাধারণ মানুষ সেই কেকের ভাগ পাচ্ছে তো?
ফিরি তথ্যে। সরকারি তথ্য আরও বলছে যে আগামী অর্থবর্ষে কিন্তু বাজার ঘুরে দাঁড়াবে আর ২০২১-২২ সালে বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ২০ শতাংশে! মনে হতেই পারে বিরাট ব্যাপার। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে এই বৃদ্ধি কিন্তু চলতি বছরে সংকুচিত জিডিপি-র উপরে। মানে ১ থেকে বেড়ে যখন ২ হয়, বৃদ্ধি তখন হয় ১০০ শতাংশ। দুই থেকে ৩ কিন্তু ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি।
জিডিপি-র অঙ্ক
ধরা যাক ২০১৯-২০ সালে জাতীয় উৎপাদন ছিল ১০০
চলতি বছর শেষে তা ৯.৫ শতাংশ কমে দাঁড়াল ৯০.৫ (১০০ - ৯.৫)
আগামী বছরে তা বাড়ল ২০ শতাংশ, হল ৯০+১৮.১ = ১০৮.৫
২০১৯-২০ তুলনায় বৃদ্ধি {(১০৮.৫-১০০)/১০০}১০০ = ৮.৫%
অর্থাৎ এই অঙ্ক বলছে, ২০১৯-২০ সালের পরেই যদি ২০২১-২২ আসত তা হলে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার দাঁড়াত ৮.৫ শতাংশ! অনেকেই বলছেন সেটা বেশ ভাল খবর। কিন্তু মাঝখানের একটা বছরে যে ক্ষতিটা হল সেটার অঙ্কটাও তো ভাবতে হবে!
ঘুরিয়ে ভাবি। ২০১৪ সালে ধরা যাক উৎপাদন ছিল ১০০। তারপর ৬ শতাংশ বৃদ্ধি। ২০১৫ সালে তাই উৎপাদন দাঁড়াল ১০৬। তারপর বৃদ্ধির হার কমল ৫ শতাংশতে। ২০১৬ সালে তাই উৎপাদন দাঁড়াল ১১১.৩। তা হলে ২০১৬ সালে ২০১৪-র তুলনায় বৃদ্ধি হল ১১.৩ শতাংশ। কিন্তু সাল ধরে দেখলে বৃদ্ধির হার কমছে। আর অর্থনীতির হাল খারাপ হচ্ছে।
জাতীয় উৎপাদন বাড়ল, কিন্তু গরিব আরও গরিব হল?
কোভিড উত্তর আর কোভিড পূর্বের এই তুলনাও তাই আমাদের আলোচনার জন্য সঠিক চিত্র দেবে না। একক ভাবে। ফিরি কেকের হিসাবে। আমরা মেনে নিই যে কোভিডের আগে পরের আর্থিক হালটা নিয়েই আমরা বিচার করব কেকের অধিকার নিয়ে।
মেনে নেওয়া যাক ভারতের বৃদ্ধির অঙ্কটা বেশ ভাল। এমনকি মাথাপিছু গড় জাতীয় উৎপাদনের অঙ্কটাও বেশ ভাল। দেশের সাধারণ মানুষ সেই কেকের ভাগ পাচ্ছে তো?
তথ্য বলছে— না। অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা না করে শুধু দেশের অঙ্কটা মেলালেই দেখব আমাদের দেশে বঞ্চনা আর অসাম্য বাড়ছেই। আমরা গড় জাতীয় উৎপাদনের অঙ্কটা করি তার কারণ হচ্ছে দেশের উন্নয়নের হিসাবটার ভিত্তি সেটাই। আমরা যদি দেখি, দেশের জাতীয় উৎপাদন হয়ত বিরাট হারে বাড়ছে না, কিন্তু বৈষম্য কমছে তা হলে স্বস্তির একটা জায়গা তৈরি হয়। কারণ উন্নয়ন মানে তো সেটাই। সাধারণ মানুষের আয় বাড়ছে। দারিদ্র কমছে। কিন্তু যদি উল্টোটা হয়? মানে জাতীয় উৎপাদন বাড়ল, কিন্তু গরিব আরও গরিব হল?
আরও পড়ুন: গোটা দেশের চাষির স্বার্থ যে এক নয়, সেটা মনে রাখা দরকার
আর সমস্যাটা এখানেই। আমরা যখন জাতপাতের রাজনীতি নিয়ে ভোট বাক্সের হিসাব নিয়ে ব্যস্ত তখন কিন্তু আম জনতার হাঁড়ির জলে ফেলার জন্য চাল বাড়ন্ত। নীচে সূচকে আমাদের অবস্থান দেখে নেওয়া যাক:
বিশ্ব ক্ষুধা সুচকে ভারত
২০০০ সাল ৩৮.৯
২০১২ সাল ২৯.৩
২০২০ সাল ২৭.২
অর্থাৎ আমাদের দেশ আধপেটা খেয়ে বা না খেয়ে থাকা নাগরিকের সংখ্যা কমছে কিন্তু আমরা অন্যদের তুলনায় এই কমানোর দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছি। (এই সূচকে যে সব দেশ ২০ থেকে ৩৪.৯ এর মধ্যে তাঁদের হালকে খারাপ বলা হয়। আর সূচকের অঙ্ক যত কমে তত ভাল হিসাবে দেখা হয়।) মাথায় রাখতে হবে মায়ানমার, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ কিন্তু ক্ষুধা কমানোর দৌড়ে আমাদের পিছনে ফেলে দিয়েছে।
আরও পড়ুন: মতের পার্থক্য বা বিরোধিতা হতেই পারে, তবু সংলাপ জরুরি
এই অঙ্কে আর একটা চিন্তার জায়গা কিন্তু বড় হচ্ছে। পাঁচ বছরের শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধির হার কিন্তু ক্রমাগত কমছে। অর্থাৎ আমাদের শিশুদের পুষ্টি ঠিক মতো হচ্ছে না। তাই ক্ষুদ হয়ত জুটছে। পেটের খিদে মরছে। কিন্তু পুষ্টি হচ্ছে না। পকেটে টাকা না থাকলে পুষ্টি হবে কোথা থেকে? বিল অ্যান্ড মাটিল্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের পূর্ভি মেহতার অঙ্কে ভারতে ২২.৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক পুষ্টির অভাবে ভোগেন, আর ৩৮ শতাংশের দৈহিক বিকাশ অসম্পূর্ণ! আর এর কারণ একটাই। দেশের জাতীয় উৎপাদন বাড়লেও তার ভাগ থেকে এঁরা বঞ্চিত। খিদে মেটানোর সংস্থান হয়ত হচ্ছে। কিন্তু সুস্থ বাঁচার রাস্তায় হাঁটতে গেলে যে আয় এঁদের হাতে পৌঁছনর দরকার সে রাস্তার দিশা আমরা দিতে পারছি না।
পাঁচ বছরের শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধির হার কিন্তু ক্রমাগত কমছে।
আয় বণ্টনের অঙ্কও কিন্তু একই কথা বলছে। ইউএন হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৯ বলছে, আয়ের সিঁড়িতে প্রথম ১ শতাংশের আয় যখন বৃদ্ধি পেয়েছে ২১৩ শতাংশ, তখন আয়ের নিরিখে সিঁড়ির নীচের ৪০ শতাংশের আয় বেড়েছে মাত্র ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ আয় বৈষম্য বাড়ছেই!
হিসাবটা তো দাঁড়াচ্ছে এ রকম— বৃদ্ধির হার যাই হোক না কেন, জাতীয় আয় বাড়ছে। তুলনায় কম বা বেশি। ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যাও কমছে। কিন্তু তাঁরা তো অপুষ্টিতেও ভুগছেন। মানে তো একটাই। পুষ্টিকর খাদ্য কেনার আয় তাঁদের জোটে না। পাঁচ বছরের শিশুদের অপুষ্টিতে ভোগার অঙ্ক উপরের দিকে। অর্থাৎ তাদের বাবা মা তাদের মুখে সেই পুষ্টি তুলে দিতে পারছেন না, যা এই বয়সে প্রয়োজন। অথচ জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার গত ছয় বছরে ক্রমাগত পড়লেও কোভিডের আগে তাতে সংকোচন হয়নি। অর্থাৎ কেকের আয়তন বেড়েই চলেছে। কিন্তু তার সিংহভাগটাই জুটছে দেশের উচ্চবিত্তদের। দারিদ্র কিন্তু ভারতে এই অঙ্কে বাড়ছেই।
জাতপাতের বিভেদের সঙ্গে, বাড়তে থাকা এই আর্থিক বৈষম্যও কিন্তু বেশ চিন্তারই। কোনটা বেশি দুশ্চিন্তার সেটা নিয়ে ভাবার বোধহয় সময়ও পেরিয়ে যাচ্ছে।