সঙ্গীত সাধনায় নজরুল ইসলাম। ফাইল চিত্র
কবি নজরুল ইসলামের সঙ্গে বাংলাদেশে যাওয়া ও সেখানে কবিকে ঘিরে উন্মাদনার ঘটনাবহুল ছবি মনে ভেসে উঠলে আজও উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন দুলাল শেখ। বাংলাদেশে যাওয়ার ব্যাপারে কলকাতায় তাঁর ‘লোকাল গার্জেন’ কালু শেখকেও জানিয়ে রেখছিলেন দুলাল। ‘কালু মামা’ যাওয়ার বিষয়ে সম্মতি দেন। এমনকি বাড়িতে দুলালের বাবাকে বোঝানোর দায়িত্বও নিয়েছিলেন।
তার পরের ঘটনাগুলি আজও ছবির মতো ভেসে ওঠে আজকের বৃদ্ধ দুলাল শেখের চোখের সামনে। বস্তুত, দমদম বিমানবন্দের, কবির বিমানে ওঠার সময়কার অদ্ভুত এক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছেন দুলাল। যা ভুলতে পারেননি তিনি। সে কথা পরে অনেককে শুনিয়েছেনও প্রসঙ্গক্রমে। নজরুলের পুত্রবধূ উমা কাজী আর দুলাল নিজে কবিকে ধরে ধরে সিঁড়ি বেয়ে তুলছিলেন বিমানে। মাঝপথে হঠাৎ হাত ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন কবি। সিঁড়ির উপর থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে গভীর মনোযোগে দেখতে থাকলেন চারপাশ। এক-দেড় মিনিট তো হবেই। দুলালের আজও স্পষ্ট মনে আছে, কবির চোখ দু’টি যেন সজল হয়ে উঠছিল তখন। আজও দুলালের মনে হয়, ভিতরে ভিতরে কবি যেন বুঝতে পারছিলেন, তাঁকে দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। উমা কাজী একটু নেমে এসে পুনরায় শিশুর মতো কবির হাত ধরে বুঝিয়ে উপরে তুলেছিলেন।
ঢাকা বিমানবন্দরে নামার পরে মানুষের সেই উন্মাদনার ছবি আজও চোখে ভাসে দুলালের। লোকে লোকারণ্য চারপাশ। মেলা-খেলাতেও কোনও দিন এত লোক দেখেননি দুলাল। গাছের উপরেও লোকজন উঠেছে কবিকে একটি বার দেখার জন্য। মুস্তাফা কামাল এসেছেন গাড়ি নিয়ে, এসেছে আরও অনেক পুলিশের গাড়ি। তাঁদেরকে ধানমণ্ডি রোডের ‘কবিভবনে’ নিয়ে যাওয়া হল। সেখানেই সরকারি তত্ত্বাবধানে কবি-সহ পরিবারের সকলের থাকার সুপরিকল্পিত আয়োজন করা ছিল। সেখানে বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো লোকজন আসতে থাকল কবিকে দেখতে। ফুলমালা সজ্জিত কবিকে একটা ঘরে বসানো হত। দু’টি আলাদা লাইন, পুরুষ ও মহিলাদের। শুধু একবার সামনে এসে দেখা, ফুলের স্তবক রাখা পায়ের কাছে, প্রণাম করা। চাইলে দ্রুত ছবি তোলা ক্যামেরায়। প্রায় সমস্ত দিন এই জনস্রোত চলত। কবির দর্শনপ্রত্যাশীদের সামলাতে পুলিশও হিমশিম খেয়ে যেত। এ রকম ভিড় দিন কুড়িরও বেশি সময় ধরে চলেছিল বলে দুলালের মনে আছে। পরে স্কুল থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা আসতেন। বাস রিজার্ভ করে বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে সাধারণ মানুষও আসতেন।
দুলালের দিব্যি মনে পড়ে, প্রতিদিনের জমা ফুলের তোড়ায় একটা বড় ঘর ভর্তি হয়ে যেত। নাজমা নামের একটি মেয়ে ঘরদোর সব পরিষ্কার করত। আর ছিল হাসি নামে আর এককটি মেয়ে বাড়ির অন্য কাজকর্ম করার জন্য। বাবুর্চি মোজাফ্ফর হোসেন সবার রান্না করতেন। আবদুল্লাহ ও খালেক নামে দু’জন তাঁকে সাহায্যের জন্য ছিলেন। তাঁরাই খাবার টেবিলে খাবার পরিবেশন দিতেন। কবিভবনে সর্বক্ষণের জন্য পুলিশ মোতায়েন থাকত। পুলিশ অফিসার আবোল মিয়াঁর নিয়ন্ত্রণে অন্য পুলিশকর্মী লাল মিয়াঁ, ইউসুফ মিয়াঁ, ইমদাদ, হেলাল মিয়াঁরা বিভিন্ন সময় ডিউটিতে থাকতেন। পুলিশদেরও রান্না হতো বাড়িতে। সরকারের তরফ থেকে মোটরগাড়িও দেওয়া হয়েছিল। প্রথমে একটি সাদা গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন ড্রাইভার নুরু। এক সপ্তাহ পরে তোফিজুল ও হুমায়ুন নামের অন্য দু’জন ড্রাইভারও এসেছিলেন। এঁরা পালা করে আসতেন। হুডখোলা গাড়িতে করে সপ্তাহান্তরে কবিকে বাইরে বেড়াতে নিয়েও যাওয়া হত। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে দুলালও যেতেন সে গাড়িতে। খালেক নামে এক মালী নিযুক্ত হয়েছিলেন বাড়ির বাগানের পরিচর্যায়। মেডিক্যাল কলেজ থেকে মিলিতা ও মঞ্জু নামের নার্সকে সকাল ন’টায় গাড়ি এসে রেখে যেত, রাত আটটা-সাড়ে আটটায় আবার তাঁদের নিয়ে যাওয়া হত।
সে-সব দিনের স্মৃতি আজও মনের পর্দায় ছবির মতো ভেসে ওঠে দুলালের। আগ্রহী শ্রোতা পেলে আদ্যোপান্ত গড়গড় করে শোনান সে সব কাহিনি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে চিকিৎসক এন চৌধুরী সপ্তাহে দু’দিন আসতেন কবির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে। কবিকে গান শোনানোর জন্য বাংলাদেশ বেতার থেকেও প্রতিদিন শিল্পীরা আসতেন। আসতেন সফিকুল ইসলাম। তবলচি থাকতেন আতিকুর রহমান, হারমোনিয়াম বাজাতেন পরিতোষ সাহা। এ ছাড়াও প্রায়ই আসতেন ফিরোজা বেগম। দুলালের অনুমান অনুযায়ী তখন তিনি মধ্যবয়সি হবেন। শোহরাব হোসেন, আব্দুল জব্বার, আব্দুল আলিমের মতো জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পীরা এসেও গান শোনাতেন নজরুল ইসলামকে। তবে গান বা সুর মনঃপূত না হলে তখনও কবি উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। পছন্দ হলে বিভোর হয়ে তাল দিতেন নিজের দুই হাতে। দুলাল শেখ বাংলাদেশের চিত্রতারকাদেরও কবিভবনে আসতে দেখেছেন বহুবার। রাজ্জাক, উজ্জ্বল, পিন্টু, সুচন্দা, শাবানা সবাই যেতেন কবিকে দেখতে। কুমিল্লায় একবার নজরুল অ্যাকাডেমির অনুষ্ঠানে কবি-সহ সকলের যাওয়া এবং কয়েকটা দিন সেখানে কাটানোর স্মৃতি আজও মন থেকে মুছে যায়নি দুলালের।
এ কথা সত্যি যে, সে সময়ের কেউ নেই এখন এই বাংলায়, কবি-সান্নিধ্যের এমন অমূল্য স্মৃতিধন্য। দুলাল শেখকে পারিবারিক কারণে হঠাৎই ঢাকা থেকে চলে আসতে হওয়ায় সঙ্গে আনা হয়নি তেমন কিছু। মলিন হয়ে যাওয়া কবি নজরুলের প্রযত্নে পাঠানো দুলালের বাবার চিঠি কয়েকটি, (যেগুলি দুলালের নিরক্ষর বাবা লিখিয়ে নিতেন কয়থার শিক্ষক প্রয়াত নজরুল কাদের সাহেবের কাছে) এবং খিলখিল কাজী, উমা কাজী, বাবুল কাজীর বিমানটিকিট ক’খানি। এগুলিই স্মৃতি-টুকরো হিসেবে পরম যত্নে বুকে আঁকড়ে রেখেছেন ষাটোর্ধ্ব এই মানুষটি।
কবি নজরলের ভ্রাতুষ্পুত্র, প্রয়াত কাজী মোজাহার হোসেন কলকাতার বাড়িতে এক কালে থাকা দুলাল শেখের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের নিরন্তর চেষ্টা করতেন। পশ্চিম বর্ধমানের চুরুলিয়ার (কবির জন্মভিটে) মেয়ে হাবিবা বিবি, যাঁর শ্বশুরালয় নলহাটির কয়থায়, তাঁর মাধ্যমে যোগাযোগের সূত্রও পেয়েছিলেন চুরুলিয়ার নজরুল অ্যাকাডেমির সম্পাদক মোজাহার হোসেন। কিন্তু, কয়থা ছেড়ে দুলাল অন্যত্র বসবাস করায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় অনেক পরে। মোজাহার সাহেবের আহ্বানে বছর কয়েক আগে, তাঁর বর্তমান বাসভূমি খড়গ্রাম থানার আতাই গ্রাম থেকে দুলাল শেখ কবির ১১৭তম জন্মদিবসের অনুষ্ঠানে চুরুলিয়া গিয়েছিলেন। মোজাহার সাহেব সেদিনই উপস্থিত সকলের সামনে দুলালের পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে কবির সমাধির পাশে বসে দুলাল কেঁদে ফেলেছিলেন। পরে মোজাহার সাহেবের মৃত্যুর খবর পেয়ে দ্বিতীয়বারের জন্যও দুলাল শেখ চুরুলিয়া গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। (শেষ)
লেখক কয়থা হাইস্কুলের শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী,
মতামত নিজস্ব