স্বাধীনতা দিবসে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ দূরদর্শন দেখায় নাই। নরেন্দ্র মোদীর ‘নূতন ভারত’ দেখিয়াছে দেশবাসী। এই ভারত এমনই নূতন, যেখানে এক প্রবীণ মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁহার বক্তব্য বদলাইবার নির্দেশ দিতে পারে সরকার-পোষিত ‘স্বনিয়ন্ত্রিত’ সংস্থার কর্তা। সেই অন্যায় দাবি না মানিলে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সম্প্রসারণ বাতিল করিতে পারে তাহারা। এই নূতন ভারতে সংবিধানের মর্যাদা নাই, প্রশাসনিক বিধির মান্যতা নাই, শোভনতার বোধ নাই। প্রসার ভারতীর দায়বদ্ধতা দেশের মানুষের প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি। ভারতীয় জনতা পার্টি বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রতি নহে। দেশের সব মানুষের বাক্স্বাধীনতা যাহাতে সুরক্ষিত হয়, সেই উদ্দেশ্যে প্রসার ভারতীর কাজ করিবার কথা। ভারতের যে কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অধিকার আছে তাঁহার বক্তব্য জনসমক্ষে পেশ করিবার। কাহার কথা কাহার অপছন্দ হইল, কাহার আপত্তিকর মনে হইল, তাহা প্রসার ভারতীর বিবেচনার বিষয় নহে। কাহারও মানহানি ঘটিলে, সরাসরি দেশের সংহতি বিপন্ন হইলে বা অথবা অনুরূপ কোনও বিপদ ঘটিবার প্রত্যক্ষ প্ররোচনা থাকিলে হয়তো আপত্তি জানাইতে পারেন প্রসার ভারতীর কর্তারা। কিন্তু স্রেফ শাসকদের মত বা অবস্থানের প্রতিকূল বলিয়া মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ ‘সেন্সর’ করিবার এই তৎপরতা দেখিয়া সন্দেহ হয়, শ্রীমান পহলাজ নিহালনি কি বিদায়কালে তাঁহার চাপরাশটি প্রসার ভারতীর করকমলে সঁপিয়া গিয়াছেন?
যাঁহারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন নাই, তাঁহারাই যে আজ দেশের ঐক্যে আঘাত করিতেছেন, এমন উক্তি সংঘের নিকট উপাদেয় হইবে না, তাহা অনুমেয়। কিন্তু তাহারা গণতান্ত্রিক রীতি মানিয়া ‘আপত্তিকর’ মন্তব্যের প্রতিবাদ জানাইতে পারে। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের পক্ষে কথাগুলি অনুপযোগী— এমন সিদ্ধান্ত লইবার কী অধিকার আছে প্রসার ভারতীর? মানিকবাবু বক্তব্য বদলাইবার প্রস্তাবে রাজি হন নাই। তাঁহার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ আছে, ক্ষুণ্ণ হইয়াছে দূরদর্শনের মর্যাদা। সরকারের বক্তব্য এবং সরকার পক্ষের মতের প্রচার আকাশবাণী এবং দূরদর্শনে অধিক হইয়াই থাকে। কিন্তু বিরোধীদের জন্য স্থান যে ভাবে সংকুচিত হইতেছে, তাহার নিদর্শন খুব বেশি নাই। এ প্রসঙ্গে সত্তরের দশকের তুলনা উঠিয়া আসে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণ ‘সেন্সর’ করিবার নিদর্শন সেই অন্ধকারেও সুলভ ছিল না।
সিপিআইএম তথা অন্যান্য বিরোধী দল মানিক সরকারের পাশে দাঁড়াইয়াছে, ভরসার কথা। কিন্তু কেরলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান মোহন ভাগবতের বিজয়া দশমীর ভাষণ সম্প্রসারণের প্রসঙ্গটি তুলিয়া সীতারাম ইয়েচুরি বিষয়টিকে কিঞ্চিৎ লঘু করিয়াছেন। সংঘপ্রধান যতই প্রভাবশালী হউন, তাঁহার সাংবিধানিক মর্যাদা নাই। ত্রিপুরা সরকারের শীর্ষব্যক্তি, মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের অমর্যাদা করিলে সংবিধানের অমর্যাদা হয়। তাঁহার ভাষণ বাতিল করিয়া প্রসার ভারতী যে অপরাধ করিল, তাহা ক্ষমার অযোগ্য। যথার্থ গণতান্ত্রিক দেশ এমন কর্তাদের শাস্তি দিত। কিন্তু ভারতে তাহার সম্ভাবনা কম, মোদীর নূতন ভারতে তো তাহা নাই বলিলেও ভুল হয় না। অতএব ঐক্যবদ্ধ হইয়া বাক্যের স্বাধীনতাকে রক্ষা করিতে হইবে নাগরিককেই। মানিক সরকার ব্যক্তিমাত্র, বিপদ গণতন্ত্রের।