Democracy

রুদ্ধ ও মুক্ত

আদালত বুঝাইয়া দিল, মূলগত ভাবে বাক্‌স্বাধীনতার শর্ত ও আবহের সহিত বিন্দুমাত্র আপস না করিয়া ব্যক্তি ও সমষ্টির অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা জরুরি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২০ ০১:৪৪
Share:

ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার-এর নামে একটি উক্তি প্রচলিত: “আমি তোমার কথা না মানিতে পারি, কিন্তু তুমি যাহাতে তাহা বলিতে পারো সেই অধিকার আমি জীবন দিয়া হইলেও নিশ্চিত করিব।” মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার যে গণতন্ত্রের ভিত্তিপ্রস্তর, ভলতেয়ারের ফ্রান্স দুইশত বৎসর পূর্বেই বুঝিয়াছিল। আজিকার ভারতের কাছে তাহা সুদূরপরাহত। না হইলে আদালতকে বারংবার তাহা স্মরণ করাইয়া দিতে হইত না। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সমাজমাধ্যমে ‘অপমানজনক’ মন্তব্যের জেরে মুম্বই পুলিশ এক নাগরিকের বিরুদ্ধে সম্প্রতি তিনটি এফআইআর করিল। প্রশাসন নাগরিকের বাক্‌স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করিতেছে, অভিযুক্তের আইনজীবীর এই যুক্তির প্রেক্ষিতে বম্বে হাই কোর্ট বলিল, নাগরিককে দেখিতে হইবে, তাঁহার অবাধ বাক্‌স্ফূর্তি অন্যের ক্ষতি না করে। আদালতের পরের কথাগুলি ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ: সরকার বা সরকারের প্রতিনিধিকে উঠিতে-বসিতে সমালোচনা সহ্য করিতে হইবে। নাগরিক, বিশেষত যুব সম্প্রদায়কে মুক্ত মত প্রকাশ করিতে না দিলে তাহারা ঠিক বা ভুল বুঝিবে কী উপায়ে?

Advertisement

অর্থাৎ, আদালত বুঝাইয়া দিল, মূলগত ভাবে বাক্‌স্বাধীনতার শর্ত ও আবহের সহিত বিন্দুমাত্র আপস না করিয়া ব্যক্তি ও সমষ্টির অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা জরুরি। তাহা নাগরিকের ইতিকর্তব্য, প্রশাসকের গুরুদায়িত্ব। কিন্তু আজিকার ভারত দেখিতেছে, শাসকের বিরুদ্ধে গলা তুলিলেই নাগরিক দেশদ্রোহী। কেন্দ্র রাজ্য যেখানেই হউক, সমালোচনা সরকারের সহ্য হইতেছে না। বহুদলীয় গণতন্ত্রে বহু মতই স্বাভাবিক, কিন্তু শাসকের সুরে সুর না মিলাইলে দেশছাড়া হইবার নিদান আসিতেছে। সমাজমাধ্যমে ক্ষোভ বা ব্যঙ্গের প্রকাশে নামিয়া আসিতেছে ব্যক্তিগত আক্রমণ বা চরিত্রহননের খড়্গ। কেবল দলীয় মতাদর্শের বিরোধিতাই নহে, তথ্য ও যুক্তি দিয়া নাগরিক-স্বার্থবিরোধী বা আপত্তিযোগ্য কোনও কাজ, প্রকল্প বা পদক্ষেপের সমালোচনা করিলে সেই অভিমতকেই পাল্টা ‘ফেক নিউজ়’ বলিয়া দাগাইয়া দেওয়া হইতেছে। অর্থাৎ, শাসক সর্বদা নিখুঁত ও নির্ভুল, তাহার বিরোধিতা স্বার্থান্ধ ষড়যন্ত্র। বৎসরের মধ্যভাগে ‘রাইটস অ্যান্ড রিস্ক অ্যানালিসিস গ্রুপ’ একটি রিপোর্ট বার করিয়াছিল। তাহাতে প্রকাশ, লকডাউন চলাকালীন, মার্চ হইতে মে এই দুই মাসে সারা দেশে ৫৫ জন সাংবাদিক খবর করিতে গিয়া গ্রেফতার, এফআইআর, শমন, শোকজ়, শারীরিক হেনস্থা, মানসিক পীড়নের শিকার হইয়াছেন। তাঁহাদের বাড়ি ভাঙচুর হইয়াছে, পুলিশি হেফাজতে অত্যাচারও। এই সমস্তই পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, কোভিডকালীন অব্যবস্থা বা অন্যান্য সরকারি অনিয়ম দেখাইতে গিয়া, ঘটমান সত্যকে বলিতে গিয়া।

বুঝিতে অসুবিধা হয় না, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ১৮০টি দেশের তালিকায় ভারত কেন ১৪২তম স্থানে। ঝুলি হইতে পাছে অপশাসনের বিড়াল বাহির হইয়া পড়ে, তাই কঠোর হাতে নাগরিককে দমাইবার চেষ্টা, অক্ষমতার ভয় জয় করিতে ক্ষমতা প্রয়োগ। মহারাষ্ট্রের ঘটনায় আদালত সরকারি আইনজীবীকে জিজ্ঞাসা করিয়াছে, সমাজে বা সমাজমাধ্যমে প্রতিটি বিরোধী স্বরের বিরুদ্ধেই কি এই রূপ পদক্ষেপ করা হইবে? কতগুলি পদক্ষেপ করা যাইবে? মুক্ত কণ্ঠকে রুদ্ধ না করিয়া, তাহাকে বোঝা না ভাবিয়া শাসক বরং তাহার ভাষাটি বুঝিবার চেষ্টা করুক।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement