উৎসব: ‘যখন আশীর্বাদের মতো ঝরে পড়ে গোল...।’ বিশ্বকাপ জয়ের পর প্যারিসের শঁজেলিজে রাস্তায় আবেগের স্ফুরণ, ১৬ জুলাই। রয়টার্স
ফ্রান্সের মাটিতে ফুটবল প্রথম গোঁত্তা খায় ১৮৮০-র দশকে, ইংল্যান্ড থেকে উড়ে এসে। ইংল্যান্ডের শ্রমিকের খেলা ফ্রান্সে এসে হয়ে যায় মুষ্টিমেয় ইংল্যান্ড-প্রেমী ধনিকের বিনোদন। প্রথম মহাযুদ্ধ অবধি খেলাটিকে উদ্ভট এক শারীর অভ্যাসের বেশি কিছু ভাবা হত না। ‘‘কতগুলো শরীর ধাক্কাধাক্কি করছে, মাটিতে উল্টে পড়ছে আর কান-ফোঁড়া তীক্ষ্ণ হুইসিল... হাঁপানোর আওয়াজ, হাঁক পাড়া, বকুনি, প্রশংসা। বাঁশির শব্দ, খামখেয়ালি, বিরক্তিকর, মাথামুন্ডুহীন।’’ ১৯০৭-এ এটাই ছিল ফুটবলের বর্ণনা।
১৯২০ সালের পর ফুটবল ক্রমশ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। সেটাও প্রধানত উত্তর ফ্রান্সের শিল্প-শহরগুলিতে। ক্রমে সেটা হয়ে ওঠে পেশাদারি। ১৯২৪-এ প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় অলিম্পিক। অঁরি দ্য মঁতেরলঁ, জঁ প্রেভো, জঁ জিরোদু-র মতো প্রথিতযশা সাহিত্যিকরা কলম ধরেন। প্রেম, যৌনতা, ছোট ছোট দুঃখের বাইরে ফুটবল যেন এক অন্য রং নিয়ে আসে তাঁদের রচনায়। ‘‘যারা পাঁচ বছর টানা যুদ্ধ করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরেছে ভগ্নজানু হয়ে, আমাদের মতো যারা শুধু শেষ দিকটা লড়েছি, আমাদের পেশির মধ্যে চারিত হয়েছে এমন এক উৎকণ্ঠা যার নিরসন হয়নি— বোধ হয় তারাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে খেলাধুলায়, যুদ্ধের শরীরী মহাকাব্য আর শান্তির আমলাতান্ত্রিকতার মধ্যবর্তী অবস্থানে।’’
পৌরুষ, শরীরের মাধ্যমে জীবনের পুনরাবিষ্কার, যুদ্ধকালীন ভ্রাতৃত্ববোধ, শারীরিক সক্ষমতার ঊর্ধ্বসীমা দেখার বাসনা— এ সবই ছিল সে কালের ফুটবলকেন্দ্রিক সাহিত্যসৃষ্টির প্রধান উপাদান। ১৮৭২-এ এমিল জ়োলা ‘শারীর শিক্ষা’ শীর্ষক নিবন্ধে বলেছিলেন, মানুষ হতে গেলে ল্যাটিন কম পড়লেও চলবে, ব্যায়ামটা বেশি করা দরকার। তারই প্রতিধ্বনি করে মঁতেরলঁ বললেন, মনের ভূত ছাড়াতে চাই খেলাধুলো। ফুটবল-প্রেমে কবিতাই লিখে ফেললেন তিনি— ‘‘বলের দখল নিল, আর একা, ধীরেসুস্থে / উঠে গেল প্রতিপক্ষ গোল লক্ষ্য করে।... ওর মেধাবী দুই পা, আর হাঁটু। কচি মুখে লেগে আছে অপরূপ দৃঢ় গম্ভীরতা।’’
ফুটবল যেন নবতর এক সৌন্দর্যের দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। ফুটবলের এই শক্তি, সৌন্দর্য এক দিকে যেমন ব্যক্তিসত্তাকে পুষ্ট করত, অন্য দিকে জাতীয় সত্তাকেও গড়ে নিতে চাইত। জিরোদুর মতে ক্রীড়াক্ষেত্রই জাতির শক্তি-সামর্থ্যের পরিমাপক। ‘‘এই অনড় আইনসভার মাঝে ফুটবল আর রাগবি টিমগুলোই শুধু নাচ করে চলেছে, জাতির পক্ষে যা কল্যাণকর, সময়োপযোগী।’’ জিরোদুর মনে হয়েছিল খেলা দেখতে আসা দর্শকের দেহ আড়ে-দৈর্ঘ্যে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই মহাযুদ্ধ মধ্যবর্তী দশকগুলিতে ফরাসি সমাজ এক চরম প্রমোদ ও স্বেচ্ছাচারিতায় ডুবে গিয়েছিল। এ সবে গা ভাসিয়েও যে স্বাস্থ্য অটুট থাকছে, তার কারণ হিসেবে অনেকে চিহ্নিত করেছেন ফুটবলকে। ফুটবল খেলার মাঠে যেন এক নতুন ফরাসি জাতির উদ্ভব হয়েছে। শুধু দেহ নয়, গঠিত হচ্ছে এক নতুন নাগরিকতাবোধ। দল সেখানে দেশ ও সমাজের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ। খেলতে শেখা সমাজে বাঁচতে শেখার প্রাথমিক সোপান। কারণ ফুটবল প্রতিযোগিতা ও সৌহার্দ্যের এক আদর্শ মিশ্রণ, যেখানে ব্যক্তি ও সমষ্টি দুই সত্তারই সমপরিমাণ স্ফুরণ হতে পারে। আলবের কাম্যু ১৯৫৯-র এক দূরদর্শন সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘ভালমন্দ বিচার যেটুকু জানি, খেলার মাঠ আর নাট্যমঞ্চই আমাকে তা শিখিয়েছে। এগুলোই আমার কাছে প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে থাকবে।’’
শুধু নাগরিক নয়, ফুটবল ফরাসিকে উদ্যোগপতি হতেও শিখিয়েছে। ১৮৯৪-তে এক ক্রীড়ামোদী পিয়ের দ্য কুব্যারত্যাঁ বলছেন জীবনে উন্নতি করতে চাইলে ‘‘এক জন ভাল ফুটবল খেলোয়াড় হতে হবে, সহ্যশক্তিসম্পন্ন, ক্ষিপ্র, প্রত্যুৎপন্নমতি, ধীর-স্থির…।’’
নিন্দুকেরা বলেন, ফুটবল শোষণের হাতিয়ার, শোষিতের আফিম যা আসল সমস্যা থেকে মুখ ঘুরিয়ে মানুষকে অরাজনৈতিক করে তোলে। কিন্তু সবাই এই মত মানবেন না। তাঁরা বলবেন ফুটবল এক ‘মেলটিং পট’। ফ্রান্সের ফুটবল দলের দিকে তাকালেই তা মালুম হবে। জ়িনেদিন জ়িদান থেকে শুরু করে আজকের এমবাপে। ফুটবলেই ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন’, সাদা কালো বাদামি চামড়াকে একটি সুতোয় গাঁথবেন। রক্ষণশীল নেতা ল্য পেন-এর বিরোধী দল বলে যদি সত্যিই কিছু হয় তো সে অবশ্যই কোনও ফুটবল দল, জাতীয় বা ক্লাব স্তরে।
জিরোদু ফুটবল বিষয়ক একটি বইয়ের মুখবন্ধে লিখছেন, ‘‘ফুটবলের নিজস্বতা হল বলের চূড়ান্ত এক সম্ভাবনার সৃষ্টি।… এই খেলা হাতের ব্যবহার-বর্জিত। হাত ব্যবহৃত হলে বল আর বল থাকে না। হাত মানেই চালাকি-কৌশল। ফুটবলে চালাকি নেই, আছে শুধু নাক্ষত্রিক সম্ভাবনা।’’
ধীরে ধীরে ফরাসি সমাজে ফুটবলের পরিগ্রহণে একটা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। প্রথম পর্বে ফুটবল, প্রধানত এক মূল্যবোধ, ব্যক্তি ও জাতীয় স্তরে মন এবং শরীর গঠনের উপায়। দ্বিতীয় পর্বে আবার মূল্যবোধের থেকেও বেশি গুরুত্ব পায় তাকে ঘিরে উৎসব, স্বপ্ন, অনুভূতির দিকটি। এই দ্বিতীয় পর্বটির সূচনা হয়েছিল কমবেশি
১৯৭০/৮০-র দশকে। তবে এই দুই পর্ব পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন দু’টি প্রকোষ্ঠ নয় মোটেই।
প্রায় জিরোদুর মতো জর্জ পেরো ফুটবলের মধ্যে কবিতা খুঁজে পান, ‘‘সবাই যখন ঠিকঠাক খেলে...বল গান গায়... পা থেকে পায়ে, মাথা থেকে মাথায় যেতে যেতে বোনে তার সুর। দারুণ আস্বাদে, বল মাঠের ঘাস চিবোতে থাকে। ব্যালে। গ্যালারি গুনগুনিয়ে ওঠে আমোদে। উৎসব।’’ অলিভিয়ে মারগো পেলের সঙ্গে তুলনা করেন মাইলস ডেভিসের, ফুটবলের সঙ্গে জ্যাজের। সাহিত্য বিষয়ক জনপ্রিয় টেলিভিশন অ্যাঙ্কর ব্যারনার পিভো ফুটবলের মধ্যে খুঁজে পান লেখার অভিজ্ঞতাকে, ‘‘তিন কাঠির মধ্যে বল রাখা আর নির্ভুল ও কার্যকর পাস দেওয়ার সঙ্গে মিল আছে লেখার পরিকল্পনা ও মুন্সিয়ানার।’’
যে হেতু ফুটবল এক সৃষ্টিকর্ম, তার সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী যোগ উৎসবের, স্বপ্নের, আনন্দের। ফুটবলের মাঠে যেন নিত্য নতুন রাজার অভিষেক হয়। সে রাজা হয়তো অভিষেকের আগের দিনই পথে পথে ঘুরে বেরিয়েছিল, কেউ ফিরেই দেখেনি তাকে। ফুটবল তৈরি করে আধুনিক রূপকথা। কারও মতে, রক ও ফুটবল— গণসংস্কৃতির মাথায় এই শেষ দুই মুকুট। এই দু’টির গায়েই ঘাম আর উল্লাসের গন্ধ। রোলঁ গারোর গ্যালারিতে বা চেম্বার মিউজ়িকের হলে যা কোনও দিন মিলবে না।
শুধু সৌন্দর্য ও তীব্রতা নয়, ফুটবলের সঙ্গে অব্যর্থ মিশে আছে শৈশবের সারল্য। ১৯২০-তে জিরোদু যেমন লেখেন, ‘‘লোকের চিৎকারের ভেতর শৈশবের কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে।’’ বা, মঁতেরলঁ। তাঁঁর কাছে রবিবার মানেই মুক্তি, কাজ থেকে, সমস্যা থেকে। খেলার মুক্তি, অ-কাজের মুক্তি, সারল্যের মুক্তি। বা কাম্যু যেমন বলছেন ‘পতন’ উপন্যাসে। ‘‘ঠাসা গ্যালারিতে রবিবারের ম্যাচ, আর থিয়েটার হল... পৃথিবীর এই দুটি জায়গায় একমাত্র নিজেকে একেবারে সরল মনে হয়।’’
ফ্রান্সে ফুটবলকে নিয়ে উন্মাদনার শেষ নেই। সেই উন্মাদনা ভাল না মন্দ, সেই বিচারের দায় আমাদের নেই। তবু সেই উন্মাদনার মধ্যেও কি কোনও শূন্যস্থান নেই? তবে পাথ্রিক দেমর্যাঁ তাঁর স্বপ্নের ফুটবল-নায়ক আল্যাঁ জিরেসকে নিয়ে গাথা লিখতে গিয়ে এত বিষণ্ণ হয়ে ওঠেন কেন?
‘‘তোমাকে অভিবাদন জিরেস.../ তুমি লড়াই কর মাঠের মাঝখানে, তোমার পা আর মাথা থেকে আশীর্বাদের মতো ঝরে পড়ে গোল/ হে বীর জিরেস, এত যুদ্ধের নায়ক/ আমাদের, এই সামান্য দর্শকদের কথা একটু ভেবো তুমি/ যার আপাতত শেষ বাঁশি বাজা অবধি/ আলেলেব্ল্য।’’