বিদ্যাচর্চায় ঠাঁই পেত লোককথা

শরৎচন্দ্র মিত্র যে ধারার প্রতিনিধিত্ব করতেন, তা বর্তমানে প্রচলিত নৃ-বৃত্ত বা এথনোগ্রাফি-র চেয়ে অনেক বেশি এথনোলজি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০১:০৬
Share:

১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর নৃ-বিজ্ঞান পঠনপাঠন শুরুর মধ্য দিয়ে দেশে বিদ্যায়তনিক ভাবে নৃ-বিজ্ঞানের সূচনা হয়। এই সময়, এক জনের কথা না বললে ভারতের নৃ-বিজ্ঞান সাধনার সূচনার ইতিহাস অসম্পূর্ণ থাকে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্যোজাত নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শরৎচন্দ্র মিত্র (ছবিতে)।

Advertisement

শরৎচন্দ্র মিত্র ১৯২০ সালে নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার প্রায় দু’দশকের বেশি আগে দ্য জার্নাল অব দ্য রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড বা ফোকলোর-এর মতো নামজাদা বিদেশি গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আর বিষয়গত ভাবে আমাদের দেশে নৃ-বিজ্ঞানের যেটি আঁতুড়ঘর, সেই অ্যানথ্রপলজিক্যাল সোসাইটি অব বম্বে-র (প্রতিষ্ঠা ১৮৮৬ সাল) মুখপত্রে দেড় শতাধিক লেখা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে তত দিনে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, তাঁর সমসময়ে ভারতে নৃ-বিজ্ঞান ও সম্পর্কিত বিষয়ের গবেষণাপত্রে তার প্রকাশিত রচনার সংখ্যা ঈর্ষণীয়। জার্নাল অব দি অ্যানথ্রপলজিক্যাল সোসাইটি

অব বম্বে-তে ১৮৩টি, বেঙ্গালুরুর কোয়ার্টারলি জার্নাল অব মিথিক সোসাইটি-তে ১২৬টি, দ্য জার্নাল অব বিহার অ্যান্ড ওড়িশা রিসার্চ সোসাইটি-তে ৪৫টি , ম্যান ইন ইন্ডিয়া-তে ৩৪ এবং এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নাল-এ ৩০টি-সহ অন্যান্য পত্রপত্রিকা মিলিয়ে প্রায় ৫০০টির কাছাকাছি গবেষণাপত্র তিনি প্রকাশ করেছেন।

Advertisement

শরৎচন্দ্র মিত্রের জন্ম ১৮৬৩ সালে, কলকাতার হোগলকুড়িয়ার মিত্র পরিবারে। শরৎচন্দ্র মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউট থেকে এন্ট্রান্স ও এফ এ পাশ করে ওই একই প্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজি অনার্স-সহ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বিএ পাশ করেন। পরবর্তী কালে এমএ ও বিএল ডিগ্রি লাভ করেন। ওকালতি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও, অচিরেই হাথোয়া রাজ এস্টেটের সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব সার্ভে অ্যান্ড সেটলমেন্ট হিসেবে নিযুক্ত হন। এই কাজের সূত্রে বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলিতে তাঁকে যেতে হত। সেই অভিজ্ঞতা এবং লৌকিক জীবনের কাহিনি তাঁর বিভিন্ন লেখায় উঠে এসেছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কর্মজীবন মাত্র পাঁচ বছরের— ১৯২০ থেকে ১৯২৫ সাল। ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি ও ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে তিনি অবসর নিতে বাধ্য হন। যদিও এর পরেও তিনি পড়াশোনা ও লেখালিখি চালিয়ে গিয়েছেন। শেষ জীবনে আতসকাচ দিয়ে বই পড়তেন, পড়া ও লেখার কাজে সাহায্য নিতেন বাড়ির মেয়ে-বৌদের। ১৯৩৮ সালে তাঁর জীবনাবসান হয়।

দেশের প্রথম নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের সূচনাকালীন সময়ের মূল্যবান অধ্যাপক, এত বিপুলসংখ্যক লেখালিখি, সমসাময়িক এমন প্রবল উপস্থিতি সত্ত্বেও, কেন ও কী ভাবে তিনি নৃ-বিজ্ঞানের ইতিহাসের আলোচনায় বিস্মৃতির অন্তরালে চলে গেলেন, এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। বরং লোকসংস্কৃতিবিদেরা অনেক গুরুত্ব দিয়ে তাঁর কথা বলেছেন। তা হলে কি লোকসংস্কৃতিবিদ পরিচিতির আড়ালে হারিয়ে গিয়েছেন নৃ-বিজ্ঞানের এই প্রবীণ সাধক? আসলে এর উত্তর লুকিয়ে আছে নৃ-বিজ্ঞানের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের মধ্যে।

শরৎচন্দ্র মিত্র যে ধারার প্রতিনিধিত্ব করতেন, তা বর্তমানে প্রচলিত নৃ-বৃত্ত বা এথনোগ্রাফি-র চেয়ে অনেক বেশি এথনোলজি। এই ঘরানার নৃ-বিজ্ঞানকে বলা হয়েছে ‘আরাম কেদারার নৃ-বিজ্ঞান’। তৎকালীন জগৎবিখ্যাত নৃ-বিজ্ঞানীদের অনেকেই এই ধারার— যেমন ফ্রেজার, ল্যাং প্রমুখ। ক্ষেত্রসমীক্ষা-নির্ভর না হয়ে বিভিন্ন ভ্রমণকাহিনি, ডায়েরি, বিবরণী ইত্যাদি রচনাগুলি থেকে রসদ নিয়ে মানব সমাজ-সংস্কৃতির একটি তুলনামূলক ইতিবৃত্ত নির্মাণ করা হয় এখানে। এই লেখাগুলির একটা বড় অংশই জনপ্রিয় রচনা, যা সাধারণ মানুষ আগ্রহভরে পড়তেন। আজ যাকে পাবলিক ও পপুলার অ্যানথ্রপলজি বলা হচ্ছে, তার পূর্বসূরি বলা যায় এ ধরনের লেখাগুলিকে।

নৃ-বিজ্ঞানের জনপ্রিয় প্রকাশ ঘটত এগুলির মধ্য দিয়ে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ নৃ-তত্ত্ব বলতে এই এথনোলজির কথাই উল্লেখ করেছেন। আচার, প্রথা, সংস্কার, ধর্ম, মৌখিক ঐতিহ্য যেমন লোককথা, ছড়া, ধাঁধা, ইত্যাদি বিষয় এই সমস্ত আলোচনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। নৃ-বিজ্ঞান পাঠ্যক্রমেরও অংশ ছিল এগুলি। অর্থাৎ এই হিসেবে পৃথিবীর আরও অনেক দেশের মতো আমাদের এখানেও সূচনাপর্বে লোকসংস্কৃতির সঙ্গে নৃ-বিজ্ঞানের বৈষয়িক গাঁটছড়া বাঁধা ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নৃ-বিজ্ঞানের পুরোধা ফ্রাঞ্জ বোয়াস সতেরো বছর ফোকলোর সম্পাদনা করেছেন। সুতরাং, এই নিরিখে শরৎচন্দ্র মিত্র তাঁর সময়ের নৃ-বিজ্ঞানচর্চার মধ্যে যথাযথ ভাবে প্রোথিত ছিলেন।

শুধু তা-ই নয়, ভারতীয় নৃ-বিজ্ঞানের সূচনায় যে ক’টি ধারা একে রসদ জুগিয়েছে, তার একটির প্রধান প্রতিনিধি ছিলেন শরৎচন্দ্র মিত্র। নৃ-বিজ্ঞানের লোকসাংস্কৃতিক ধারার মধ্যে দিয়ে দেশীয় ঐতিহ্যের অন্বেষণ ভারতীয় নৃ-বিজ্ঞানের উপাদানগত ভিতটিকে পুষ্ট করেছিল— যে ভিত্তির উপর নৃ-বিজ্ঞানের ভারতীয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দানা বাঁধে। বিশ শতকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশক থেকে ম্যালিনোস্কির ধারার ক্ষেত্রসমীক্ষাভিত্তিক গবেষণা ও নৃ-বৃত্ত রচনা এথনোলজি-ঘেঁষা নৃ-বিজ্ঞানকে পিছনে ফেলে দেয়। ফলত নৃ-বিজ্ঞান চর্চায় গৌণ হয়ে পড়তে থাকে শরৎচন্দ্র মিত্রের পথ। এই সময় লোকসংস্কৃতি নামক বিদ্যায়তনিক ক্ষেত্রটির ক্রমশ প্রথাগত প্রতিষ্ঠা ও বর্গ বিভাজনের কৌশলে হারিয়ে যায় পথিকৃতের বৃত্তান্ত। তাই ইতিহাস ও সত্যের খাতিরে শরৎচন্দ্র মিত্রের স্বীকৃতিটুকু দেওয়ার সময় আজ এসেছে।

নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement