আর্জি: আতসবাজি পোড়ানোর বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের মিছিল। ফাইল চিত্র
গত মাসের মাঝামাঝি একটি খবর ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস বদলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। হরিয়ানার হিসার জেলার রাখীগড়ে প্রাপ্ত নরকঙ্কাল ও ভগ্নাবশেষ থেকে অনুমান করা যায় এটি পাঁচ হাজার বছরেরও পুরনো। সেখান থেকে প্রাপ্ত কঙ্কালগুলির ডিএনএ পরীক্ষা করে মৃত কঙ্কালের শরীরে কোনও আক্রমণের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, অনুমান করা যেতে পারে, এদের মৃত্যু হয়েছিল কোনও প্রাকৃতিক কারণে। তাহলে প্রশ্ন নগরকেন্দ্রিক উন্নতমানের সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল কী ভাবে? খরা, বন্যা না দূষণ?
একটি সিগারেট মানুষের আয়ু ১১ মিনিট পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। একটি আতসবাজি থেকে নির্গত ধোঁয়া ৫০০টি সিগারেটের সমান। অর্থাৎ, ৫,৫০০ মিনিট বা ৩.৫ দিন আয়ু কমায়। ৪০ বছরের হিসাব ধরলে তা প্রায় দু’বছরের কাছাকাছি।
সামনে দিপাবলি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা এখনও যথেষ্ট সচেতন হচ্ছি না। দূষণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বা সাম্প্রতিক সুপ্রিম কোর্টের পরিবেশবান্ধব বাজি (গ্রিন ক্র্যাকার্স) পোড়ানোর নির্দেশকে অমান্য করে যথাযথ নিজেদের অবস্থানে সক্রিয় থেকে প্রকৃতি ও সভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর হয়ে উঠছি। চলুন দেখি, নিজেদের ধ্বংসকে কী ভাবে তরান্বিত করছি আমরা।
দিল্লিতে গত বছরে আতসবাজি জনিত বায়ুদূষণের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আতসবাজি পোড়ানোর এক দিনের মধ্যে বাতাসের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ৯৬ থেকে পৌঁছেছিল ৯৬০-এ। এখন এই এক দিনে বাতাসকে যে পরিমাণ দূষিত করা হয় তা ৫৫ দিনের দূষণের সমান।
আজ থেকে ২০০০ বছর আগে চিনের একটি রান্নাঘরে রান্নার সময় ব্যবহৃত কাঠকয়লা, গন্ধক, সল্টপিটার-এর সংস্পর্শে আলো ও শব্দ উৎপন্ন হয়। সেই শুরু। মনে করা হয়, তার পর থেকেই ওই রাসায়নিক পদার্থগুলি নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছিল আতসবাজির। বর্তমানে এই আতসবাজি অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইয়ার ডে, আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস এবং ভারতের দীপাবলিতে ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হয়।
আতসবাজির মূল উপাদান হল চারকোল, গন্ধক বা সালফার এবং এদের সংস্পর্শে জ্বলে ওঠা পদার্থকে অক্সিজেন দেওয়ার জন্য পটাশিয়াম নাইট্রেট বা ক্লোরেট। এ ছাড়া, আতসবাজির রঙের বাহার দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ধাতব পদার্থ যেমন অ্যালুমিনিয়াম, কপার বা তামা, লোহা ইত্যাদি চূর্ণ মেশানো হয়।
আতসবাজিতে যে পটাশিয়াম নাইট্রেট মেশানো হয়, তা শরীরে ধোঁয়া বা কণা আকারে প্রবেশ করলে তা রক্তে মিশ্রিত আয়োডিনকে গলায় থাকা থাইরয়েড গ্রন্থিতে যেতে বাধা দেয়। ফলে থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয় কম। এই থাইরয়েড শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশে সহায়তা করে। শরীরে কম মাত্রায় থাইরয়েড হরমোন থাকার অর্থ শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ব্যাহত হওয়া।
যে ধাতব পদার্থগুলি বাতাসে মিশে আমাদের ক্ষতি করে, তার মধ্যে অ্যালুমিনিয়াম অন্যতম। আতসবাজিতে সাদা আলো তৈরি করতে এই ধাতব কণা ব্যবহার করা হয়। অতিরিক্ত মাত্রায় অ্যালুমিনিয়াম মস্তিষ্ক ও ফুসফুসের ক্ষতি করে। বয়স্কদের অ্যালঝাইমার্সে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
নীল রঙের আতসবাজি তৈরি করতে তামা বা কপার ব্যবহৃত হয়। এরা পটাশিয়াম পার ক্লোরেটের সংস্পর্শে ডাই-অক্সিন যৌগ তৈরি করে। ‘ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনে’র (হু) মতে এটি ক্যানসার সৃষ্টিকারী পদার্থ। এ ছাড়া, এর জেরে মুখে ব্রণ উৎপন্ন হয়। শরীরে বিভিন্ন ধরনের হরমোন তৈরিতে বাধা প্রদান করে। গ্লুকোজ বিপাক ব্যাহত হয়।
সবুজ রঙের আলো সৃষ্টিকারী আতসবাজি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বেরিয়াম ধাতু। এই বেরিয়াম যুক্ত আতসবাজি বিস্ফোরণের ফলে বাতাসে বেরিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এই বেরিয়াম মানুষের ক্ষেত্রে হৃৎপিণ্ডের গতিকে অনিয়মিত করে তোলে। এ ছাড়া, মাংসপেশীকে দুর্বল করা, উচ্চ রক্তচাপ জনিত অনিয়ন্ত্রিত প্যারালাইসিস থেকে মৃত্যুর কারণ পর্যন্ত হতে পারে বেরিয়াম।
বেগুনী রঙ সৃষ্টিকারী আতসবাজিতে ব্যবহার করা হয় রবিডিয়াম। এই ধাতু নরম এবং এর গলনাঙ্ক ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। জলে এরা ভীষণ ভাবে প্রতিক্রিয়াশীল। কোনও ভাবে শরীরে প্রবেশ করলে রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা বিনষ্ট করে।
এ ছাড়া, অনেক আতসবাজিতে ক্যাডমিয়াম মেশানো থাকে। এটি শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে পৌঁছয় এবং শ্বাসকষ্ট তৈরি করে। জলজ প্রাণিরাও খাবারের সঙ্গে বা জলে মেশা ক্যাডমিয়াম গ্রহণ করে। সুতরাং, খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে তা প্রবেশ করে মানুষের শরীরে। শরীরে ক্যাডমিয়ামের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে হাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ক্যানসার তরান্বিত হয়। ফুসফুসে শ্বাসপ্রশ্বাসে বাধা সৃষ্টি করে। কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত।
আতসবাজিতে শুধুমাত্র বায়ুদূষণই হয় না। এর থেকে শব্দদূষণ, মাটি দূষণ এবং জলদূষণও হয়। মানুষের উপরেই শুধু দূষণের প্রভাব পড়ে না। প্রাণি, উদ্ভিদ, পশু, পাখি এমনকি, ক্ষুদ্র কীট পতঙ্গও এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আতসবাজিতে ব্যবহৃত ক্ষতিকারক রাসায়নিক জলে মিশলে তা থেকে তা মাছ-সহ অন্যান্য জলজ জীবের শরীরে প্রবেশ করে। সেই জীব যখন খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে তার খাদক শ্রেণির শরীরে প্রবেশ করে, তখন তারও ক্ষতি করে।
এতেই বুঝছি এক দিনে কয়েকঘণ্টার আতসবাজিতে আমরা যে ৫৫ দিনের দূষণকে টেনে নিয়ে আসছি, তাকে যে কোনও ভাবেই আটকাতে হবে। নতুবা আরেক রাখীগড় তৈরিতে আমরা সহায়ক হব।
এই পরিস্থিতিতে যে কোনও রকমের বাজির ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়া দরকার। ফিরে যাওয়া উচিত সলতে-প্রদীপের দিনে। অথবা ব্যবহার বাড়াতে পারি লেজ়ার রশ্মির বাহারি আলোর। গ্রিন ক্র্যাকার বা পরিবেশবান্ধব বাজির ব্যবহার বাড়ানোর ইচ্ছে থাকলেও খরচের কথা ভেবে উপায় হয়ত এখনই নেই। সবশেষে আমাদের উচিত একজন সচেতন নাগরিক হয়ে ওঠা। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পালন করা। এ ছাড়া রাজ্য সরকারগুলিরও উচিত আতসবাজি ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণে আরও ভাল ভাবে নজর রাখা।
লেখক পুরুলিয়ার চিকিৎসক