সম্পাদকীয় ২

মাথা হেঁট

যদি পরিস্থিতি বদলাইতে হয়, তবে আজ শিক্ষাবৃত্তি, কাল প্রশিক্ষণ, পরশু মহিলা হস্টেল খুলিয়া ক্ষমতায়নের নাটক বন্ধ করিতে হইবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share:

ভারতে তিন জন মহিলার দুই জন খাটিয়া মরেন বিনা পয়সায়। যাঁহারা মজুরি পান, তাঁহাদেরও জোটে পুরুষের অপেক্ষা কম। এই বৈষম্য বিশ্বের দরবারে ভারতের মাথা নিচু করিল। অর্থনীতির দৃষ্টিতে ‘জেন্ডার গ্যাপ,’ অর্থাৎ পুরুষ ও নারীর ফারাক মাপিয়া দেখে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম। তাহার সাম্প্রতিক রিপোর্ট ভারতকে অনুন্নত দেশগুলির সহিত স্থান দিয়াছে। মেয়েদের প্রতি আর্থিক বৈষম্য ঘুচাইবার কাজে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের পশ্চাতে ভারত। তাহাদের অনেকগুলিই ভারতের তুলনায় দরিদ্র। এই দেশের আর্থিক বৃদ্ধি বহু দেশের নিকট ঈর্ষণীয় হইতে পারে। কিন্তু সেই সম্পদ যে দেশের অর্ধেক মানুষের জন্য স্বাস্থ্য কিংবা সমৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করিতে পারে নাই, তাহা ফের স্পষ্ট হইল। বৈষম্যের তুলনামূলক অবস্থানে বাংলাদেশের স্থান যেখানে সাতচল্লিশ, চিনের একশো, সেখানে ভারত দাঁড়াইয়া আছে একশো আট নম্বরে। মেয়েদের আয়ু এবং স্বাস্থ্যের সূচকে ভারতের স্থান একশো চুয়াল্লিশটি দেশের মধ্যে একশো একচল্লিশ। এই অসম্মান অপ্রত্যাশিত নহে। বহু সূচকেই ভারতের মহিলারা অত্যন্ত পিছাইয়া আছেন। প্রথমত, মেয়েদের উচ্চশিক্ষার হার বাড়িলেও কর্মক্ষেত্রে যোগদানের হার বাড়ে নাই। দ্বিতীয়ত, কর্মরত মহিলাদের দশ জনের প্রায় নয় জনই স্থান পাইয়াছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে, যেখানে রোজগারের নিরাপত্তা বা সমতা নাই।

Advertisement

তৃতীয়ত, অংসগঠিত ক্ষেত্রেও শ্রমিকদের রাষ্ট্রের নিকট যে সকল সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা পাইবার কথা, বিশেষ করিয়া মহিলা শ্রমিকরা তাহাতে বঞ্চিত। চতুর্থত, সংসদে, বিধানসভায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব অতি সামান্য। প্রশাসন, শিল্প, প্রযুক্তি, পরিষেবা, প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত লইবার পদে যথেষ্ট মহিলা নাই। এই রিপোর্ট বলিয়াছে, যে দেশে পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে এক নারী প্রধানমন্ত্রী হইয়াছিলেন সেখানে আজও কেন নেতৃত্বে যথেষ্ট মহিলা নাই? এই প্রশ্নটি গুরুভার হইয়া উঠিয়াছিল বলিয়াই তড়িঘড়ি পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অর্ধেক আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়। কিন্তু পঞ্চায়েত ব্যবস্থাটিই এখন রাজনীতিতে ‘এলেবেলে’।

যদি পরিস্থিতি বদলাইতে হয়, তবে আজ শিক্ষাবৃত্তি, কাল প্রশিক্ষণ, পরশু মহিলা হস্টেল খুলিয়া ক্ষমতায়নের নাটক বন্ধ করিতে হইবে। মহিলাদের শ্রম আত্মসাৎ করে তাঁহাদের পরিবার। তাঁহাদের দক্ষতা, কুশলতা, কায়িক শ্রম, মেধা, বুদ্ধি, সকলই ব্যয় হয় পারিবারিক উৎপাদন, সন্তানপালন এবং গৃহকার্যে। অথচ পারিবারিক সম্পদে মেয়েদের অধিকার নাই, উত্তরাধিকারেও তাঁহারা বঞ্চিত। সম্মান-সমাদরের লোভ এবং লজ্জা-কলঙ্কের ভয়, ইহাই মেয়েদের দাসত্বে বাঁধিয়াছে। অতএব কেবলমাত্র আরও শিক্ষা, আরও প্রশিক্ষণে কাজ হইবে না। মেয়েদের সক্ষম করিতে হইলে পরিবারের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাইতে হইবে রাষ্ট্রকে। মেয়েদের অধিকারকে পরিবারের বৃত্তের বাহিরে দেখিতে হইবে রাষ্ট্রের নীতিকে। বিবাহ হইতে উত্তরাধিকার, নিয়োগের শর্ত হইতে পেনশন, পুরুষতন্ত্রের মূলে আঘাত করা প্রয়োজন। সক্ষমতার বিবিধ প্রকল্প গোড়া কাটিয়া আগায় জল দিবার শামিল হইবে। সংবৎসর ঢাকঢোল বাজিবে, কিন্তু মূল্যায়নের ফল বাহির হইলে মুখে চুনকালি পড়িবে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement