নাগেরবাজারের একটি বাড়িতে কাজ করছেন দেবজিৎ ও তাঁর সহযোগীরা।
ঘোর অন্ধকারে কিছু আলোর স্ফুলিঙ্গ। হয়তো সামান্য, কিন্তু উজ্জ্বল। চাহিলে ওই আলোকেই ঠিক দিশাটি খুঁজিয়া পাওয়া যায়। দিশা, নাগরিক দায়িত্ববোধের। সাম্প্রতিক করোনা-আবহে যে দায়িত্ববোধের কথা বারংবার স্মরণ করাইয়া দেওয়া হইয়াছে, অথচ বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়াছে সামান্যই। এই প্রেক্ষিতে দক্ষিণ দমদমের এক প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক এবং চিনার পার্কের বাসিন্দাদের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম হইয়া থাকিবে। শিক্ষক দেবজিৎ রায়ের স্কুলটি বন্ধ, অনলাইন ক্লাসও তেমন গতি পায় নাই। কিন্তু তিনি অলস বসিয়া থাকেন নাই। বরং ব্যক্তিগত উদ্যোগে দল গড়িয়া স্থানীয় করোনা রোগীদের বাড়ি জীবাণুমুক্ত করিবার কাজ করিতেছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানিয়া। অন্য দিকে, রাজারহাটের চিনার পার্ক অঞ্চলের বাসিন্দারা সম্প্রতি উদ্যোগ করিয়া স্থানীয় অটো এবং টোটোগুলি জীবাণুমুক্ত করিয়াছেন। চালকদের মধ্যে বিলি করিয়াছেন মাস্ক।
দুর্দিনে ব্যক্তিনাগরিকের এই উদ্যোগগুলি কম কথা নহে। বিশেষত যেখানে চূড়ান্ত অসহযোগিতা এবং স্বার্থপরতার অসংখ্য নিদর্শন প্রতিনিয়ত চোখে পড়িতেছে, সেখানে ইহা সাহস জোগায়। আশ্বস্ত করে, আজও এমন মানুষ আছেন, যাঁহারা বিপর্যয়ে প্রাণের ঝুঁকি লইয়াও অন্যের জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করিয়া যান। ১৮৯৯ সালে কলিকাতায় প্লেগের সময় জনসেবার এই উদাহরণ দেখা গিয়াছিল ভগিনী নিবেদিতার কাজে। রোগগ্রস্তদের সেবা করা এবং নিজ হস্তে আবর্জনা পরিষ্কার করিবার মধ্য দিয়া তাঁহার ‘লোকমাতা’ উপাধিটি সার্থক হইয়া উঠে। সেই কাল অতিক্রান্ত। সেই জনসেবাও প্রায় কল্পকথায় পরিণত। বর্তমান অতিমারির প্রারম্ভেই বলা হইয়াছিল, এই লড়াই কাহারও একার নহে। অতিমারির বিরুদ্ধে সংগ্রামে সকলকে একজোট হইয়াই লড়িতে হইবে। কিন্তু সংক্রমণের আতঙ্কে সেই যৌথ লড়াইয়ের অঙ্গীকারটি অনেকাংশে বিস্মৃত হইয়াছে। বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসাকর্মীদের স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনে বাধা দিয়াছেন প্রতিবেশীরা। কোথাও কোভিড-হাসপাতালে কাজ করিবার ‘শাস্তিস্বরূপ’ ভাড়া বাড়ি ছাড়িতে বাধ্য হইয়াছেন নার্স। এই সংক্রান্ত অভিযোগ মিলিলে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা হইবে— এমন হুঙ্কারেও পরিস্থিতি বিশেষ পরিবর্তিত হয় নাই। বরং করোনা-রোগীর সন্ধান পাইবামাত্র গোটা পরিবারকে একঘরে করে দেওয়া হইতেছে।
দুর্ভাগ্যজনক। বস্তুত, জনস্বাস্থ্য এমনই এক বিষয়, যাহাকে সুরক্ষিত রাখিতে চাহিলে কাহারও একার উদ্যোগ যথেষ্ট নহে। সরকার বিধি বানাইতে পারে, নির্দেশ দিতে পারে, প্রয়োজনে শাস্তির ব্যবস্থাও করিতে পারে। কিন্তু সমাজ উদ্যোগী না হইলে, দায়িত্ববান না হইলে রোগের মোকাবিলা করা অসম্ভব। শুধুমাত্র করোনা নহে। এমনকি ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাবের সময়ও শুধুমাত্র নিজের গৃহটিকে পরিচ্ছন্ন রাখিলে চলে না। সংলগ্ন অঞ্চলটিকেও পরিচ্ছন্ন রাখিতে হয়। অনুরূপে, করোনা-কালে নিয়মবিধি পালন করিতে বলিবার অর্থ ইহা নহে যে, তাহা শুধুমাত্র পালনকারীকেই সুরক্ষা প্রদান করিবে, বরং তাহা অন্যদেরও সংক্রমিত হইবার হাত হইতে রক্ষা করিবে। ইহাই দায়িত্ববোধ। সমাজে এই বোধ এখনও জাগ্রত হয় নাই। দেবজিৎরা ব্যতিক্রম। আশাপ্রদায়ী ব্যতিক্রম।