ছবি: সংগৃহীত।
পশ্চিমবঙ্গ বা মহারাষ্ট্র যদি আপত্তি জানায়, তাহাতেও কিছু আর যায় আসে না। ইতিমধ্যেই একুশটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জিএসটি কাউন্সিলের প্রস্তাবে সম্মত হইয়াছে— জিএসটি-র ক্ষতিপূরণের পরিবর্তে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বিশেষ ব্যবস্থায় ৯৭,০০০ কোটি টাকা ঋণগ্রহণে তাহাদের আপত্তি নাই। রাজ্যগুলির সবই যে বিজেপি বা তাহার শরিক-শাসিত, তাহা সমাপতন নহে। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের সাধ্য বা সাহস বিজেপির কোনও আঞ্চলিক নেতার আছে, এমন প্রমাণ গত ছয় বৎসরে মিলে নাই। অর্থাৎ, জিএসটি কাউন্সিলের নিয়ম বাহ্যিক ভাবে যাহাই হউক না কেন, প্রশ্নটি দাঁড়াইয়াছে কেন্দ্রীয় সরকার বনাম বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলির লড়াইয়ে। সংখ্যার জোরে কেন্দ্রীয় সরকার সেই লড়াই জিতিতেছে বটে, কিন্তু হারিতেছে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। ইহা অনস্বীকার্য যে কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক সব পদক্ষেপেই চাপাইয়া দিবার অগণতান্ত্রিক প্রবণতা প্রকট। কৃষি বিলই হউক বা জাতীয় শিক্ষানীতি, কোনও ক্ষেত্রেই রাজ্যগুলির মতামতের তোয়াক্কা করে নাই কেন্দ্রীয় সরকার। তবুও, জিএসটি-র প্রশ্নটি স্বতন্ত্র— তাহার উৎসগত কারণেই। জিএসটি ব্যবস্থা প্রবর্তনের স্বার্থে রাজ্যগুলি পরোক্ষ কর আদায়ের সংবিধানপ্রদত্ত অধিকারটি ছাড়িয়া দিয়াছিল। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রাজ্যগুলির জন্য যে রাজস্ব-স্বাধীনতার অবকাশ রাখিয়াছিল, সেই পরিসরটিতেই তৈরি হইয়াছে জিএসটি ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থায় প্রতিটি রাজ্যের মতামতের গুরুত্ব থাকিবে, সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে শুধু সংখ্যার জোর ব্যবহার করা হইবে না— এই প্রত্যাশাটিও ভিত্তিহীন ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক এই বিশ্বাসের জায়গাটিতেই কুঠারাঘাত করিতেছে। অতঃপর, রাজ্যগুলি যদি কেন্দ্রের কোনও সিদ্ধান্তকেই বিশ্বাস করিতে দ্বিধা করে, দোষ দেওয়া যায় কি?
জিএসটি বাবদ ক্ষতিপূরণের অর্থ রাজ্যগুলির নিকট গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত এই কোভিড-আক্রান্ত সময়ে, যখন রাজ্যগুলির খরচ আকাশছোঁয়া। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বিশেষ ঋণে সেই আর্থিক প্রয়োজনের অংশমাত্র পূরণ হইবে। কিন্তু তাহারও অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হইল, এই ঋণের দায় যে রাজ্যগুলির উপরই চাপিবে না, সেই ভরসা কোথায়? কেন্দ্রীয় সরকারের কথায় বিশ্বাস করিবার ভরসা তো নাই। এই অচলাবস্থা কাটাইতে পারিত খোলামেলা আলোচনা— জিএসটি কাউন্সিলে ভোটের অঙ্কে কেন্দ্র নিজেদের মতামত চাপাইয়া দিতে পারে কি না, সেই বিবেচনাকে সরাইয়া রাখিয়াই আলোচনার পথে হাঁটা জরুরি ছিল। রাজ্যগুলির বিশ্বাস অর্জন করা প্রয়োজন ছিল। এই সঙ্কটের মুহূর্তে তো বটেই, সব সময়েই যে দেশের স্বার্থ কেন্দ্র ও রাজ্য পরস্পরের সমানুবর্তী হইবে, কথাটি রাজ্যগুলিকে বুঝাইবার দায়িত্ব ছিল কেন্দ্রেরই। সংখ্যার অহঙ্কারে তাঁহারা কর্তব্যটি বিস্মৃত হইয়াছেন।
অতঃপর একটি বৃহত্তর প্রশ্নের অবতারণা করা প্রয়োজন— যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটি গুরুত্বপূর্ণ কেন? সংবিধান কেন কেন্দ্রের হাতেই সব ক্ষমতা ন্যস্ত করে নাই? তাহার কারণ, দেশের রূপকাররা বিশ্বাস করিয়াছিলেন যে রাজ্যের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা রাজ্যের স্বার্থের এবং প্রয়োজনের কথা বিশেষ ভাবে অনুধাবন করিতে সক্ষম। এবং, তাহাতেই রাজ্যের মানুষের মঙ্গল। জিএসটি কাউন্সিলে সংখ্যার জোরে যদি পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, পঞ্জাব, মহারাষ্ট্রের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের সরকারের মতামতকে নস্যাৎ করিয়া দেওয়া যায়, তবে মানুষেরই স্বার্থহানি। এবং, তাহা শুধু বিরোধী-শাসিত রাজ্যের ক্ষেত্রেই নহে। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে বিজেপি-শাসিত রাজ্যের নেতারা যদি রাজ্যের স্বার্থের ঊর্ধ্বে দলের কেন্দ্রীয় স্বার্থকে ঠাঁই দেন, তাহাতেও মানুষেরই ক্ষতি। দেশের মানুষের ক্ষতি করিয়া কি দেশের মঙ্গলসাধন সম্ভব?