রুম নম্বর ৩৪২০
internet

সভ্যতার ইতিহাসে থাকবে দুই যুগ: ইন্টারনেটের আগে এবং পরে

বিবর্তনে এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল যোগাযোগ। সে উপাদান আহরণে মানুষ বড় পটু, তাই সে পিছনে ফেলেছে আর সব প্রাণীকে।

Advertisement

পথিক গুহ

শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০২
Share:

লগিন। ইংরেজিতে ‘এল’ ‘ও’ ‘জি’ ‘আই’ এবং ‘এন’। ১৯৬৯ সালের ২৯ অক্টোবর রাতে লস এঞ্জেলেস-এ ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় (ইউসিএলএ)-এর ছাত্র চার্লস ক্লাইন মাত্র ওই পাঁচটা অক্ষর পাঠাতে চাইছিলেন তাঁর বন্ধু উইলিয়াম ডুভাল-কে। বন্ধু বসে আছেন ৫০০ কিলোমিটার দূরে স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআরআই)-এ। দুই বন্ধুর সামনেই ওঁদের কম্পিউটার। ক্লাইন তাঁর কি-বোর্ডে টাইপ করলেন ‘এল’। তা পৌঁছল কি না, জানতে হবে। ফোন ডুভালকে। হ্যালো, ‘এল’ পেয়েছ? ডুভালের উত্তর, হ্যাঁ, ‘এল’ পেয়েছি। এর পর ‘ও’ টাইপ। আবার প্রশ্ন, ‘ও’ পেয়েছ? উত্তর, হ্যাঁ ‘ও’ পৌঁছেছে। নিশ্চিন্ত ক্লাইনের এ বার ‘জি’ টাইপ করার পালা। এবং তা করতেই সিস্টেম ক্র্যাশ!

Advertisement

মাত্র ওই দুটো অক্ষর পাঠানোর— এবং তৃতীয় অক্ষরেই ঠোক্কর খাওয়ার— মধ্যে দিয়ে আজ থেকে ৫০ বছর আগে বীজ বোনা হয়েছিল সভ্যতার আধুনিকতম বিপ্লবের। সে দিন ৫০০ কিলোমিটার দূরবর্তী দুই কম্পিউটারের একটা থেকে অন্যটায় পাঠানো ওই ‘এল’ এবং ‘ও’-ই আজকের ইন্টারনেট। এখন মানুষে-মানুষে যোগাযোগের এক স্মার্ট পদ্ধতি। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে যাঁদের, তাঁরাই এর সেবাপ্রার্থী। যাঁরা এখনও এই পরিষেবার বাইরে, তাঁরা আর যা-ই হোন, জীবনযাপনে আধুনিক, এ কথা বলা যাবে না। সমাজ বদলে দিয়েছে ইন্টারনেট। ভবিষ্যতে কোনও ঐতিহাসিক হয়তো মানবসভ্যতার কাহিনি লিখতে বসে তা ভাগ করবেন দুই পর্বে। ইন্টারনেটের আগে এবং পরে। অর্ধশতাব্দী পূর্ণ করেছে যে বিপ্লব, তা ফিরে দেখা জরুরি।

বিবর্তনে এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল যোগাযোগ। সে উপাদান আহরণে মানুষ বড় পটু, তাই সে পিছনে ফেলেছে আর সব প্রাণীকে। যোগাযোগের প্রধান অবলম্বন যে ভাষা বা মুখনিঃসৃত শব্দ, সেটা এত দিনেও অন্য কোনও প্রাণীর আয়ত্ত হয়েছে কি না, তা খুঁজতে গবেষকেরা হিমশিম। মানুষ কিন্তু এগিয়েছে উন্নত থেকে উন্নততর যোগাযোগ মাধ্যমে আবিষ্কার করে। লিপি, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, রেডিয়ো এবং হালফিলের ইন্টারনেট। দীর্ঘ পথ।

Advertisement

বিজ্ঞান নাকি শেষ বিচারে এক যুদ্ধশিশু। এমনটা বলে থাকেন নিন্দুকেরা। কথাটা হয়তো মিথ্যেও নয়। ২০১২ সালের ৪ জুলাই ইউরোপের সার্ন গবেষণাগারে যখন আবিষ্কৃত হল হিগস বোসন ওরফে ঈশ্বরকণা, আর সে সাফল্য নিয়ে যখন খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠল পদার্থবিদ্যার জগৎ, তখন আমেরিকান ফিজ়িসিস্টদের কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এ কারণে যে, তখন ইউরোপ যে সাফল্য পেল, তা অনেক আগেই অর্জন করতে পারত আমেরিকা। যদি রুশ-মার্কিন ঠান্ডা লড়াইয়ের অবসান জল ঢেলে না দিত সাধের এক আমেরিকান উদ্যোগে।

কণাপদার্থবিদ্যা গবেষণা চিরকালই এর রাজসূয় যজ্ঞ। কোলাইডার বা কণায় কণায় ঠোকাঠুকি করার যন্ত্রগুলোকে বলা হয় ম্যাটার মাইক্রোস্কোপ। ঠোকাঠুকি করে কণা ভেঙেচুরে দেখা। আরও ছোট কণা পাওয়া যায় কি না। প্রচণ্ড জোরে ঠোকাঠুকি করতে কণাগুলোকে ছোটাতে হয় দীর্ঘ পথ। কোলাইডারের সাইজ তাই পেল্লায়। এবং বানাতে প্রচুর খরচ। বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউরোপে অনেক রাষ্ট্র মিলে তৈরি করেছিল সার্ন। কণাপদার্থবিদ্যা গবেষণায় আমেরিকার একচেটিয়া আধিপত্য খর্ব করতে। সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার-এ যখন ঈশ্বরকণা আবিষ্কৃত হয়, তখন ওই যন্ত্র ছিল মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় মেশিন। ১০০টা দেশের ১০০০ জন বিজ্ঞানী কাজ করেছিলেন ওখানে। কিন্তু তার অনেক আগে আমেরিকা নেমেছিল লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের তিনগুণ বড় এবং তিনগুণ শক্তিশালী মেশিন বানাতে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড উইলসন রেগন সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিলেন ওই যন্ত্র (সুপারকন্ডাক্টিং সুপারকোলাইডার) বানানোর। মাটির নীচে সাড়ে বাইশ কিলোমিটার সুড়ঙ্গ খোঁড়া এবং ২০০ কোটি ডলার খরচ করার পর ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে বাতিল হল ওই কোলাইডার। অজুহাত অনেক। তার মধ্যে মুখ্য হল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। ঠান্ডা লড়াই শেষ, সুতরাং, আর কী দরকার আমেরিকাকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের? সুপারকন্ডাক্টিং সুপারকোলাইডার বানানো হলে কিন্তু ঈশ্বরকণা আবিষ্কৃত হত ওখানেই।
কোলাইডারের মৃত্যুর কারণ যদি হয় ঠান্ডা লড়াই, তবে সে লড়াই ইন্টারনেটের জন্মেরও মূলে। অক্টোবর ১৯৫৭। ঠান্ডা লড়াই তুঙ্গে। সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে পাঠাল স্পুৎনিক। আমেরিকার চক্ষু চড়কগাছ! বিশেষজ্ঞদের বিচারে ‘শক অব দ্য সেঞ্চুরি’। তলে তলে এত উন্নতি করেছে সমাজতন্ত্র! ধনতন্ত্রের তো পেন্টুলুন খোলার দশা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডিউইট ডেভিড আইজ়েনহাওয়ার বললেন, ব্যাপারটা মোটেই বরদাস্ত করা যায় না। ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসেই তিনি গড়লেন নতুন সংস্থা। অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রোজেক্টস এজেন্সি (ইংরেজি আদ্যক্ষরে আরপা)। উদ্দেশ্য আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারে সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ম্যাথমেটিক্স (আদ্যক্ষরে স্টেম) চর্চায় উন্নতি। লাগে ডলার, দেবে প্রতিরক্ষা দফতর।

সে অর্থে ১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকে বিশ্ববিদ্যালয় আর রিসার্চ ল্যাবগুলোয় কেনা হল দামি দামি কম্পিউটার। তাতেও সমস্যা মিটল না। মিটবে কী করে, ঢাউস ঢাউস কম্পিউটারগুলো যে সব কাজ করে নিজের নিজের ল্যাঙ্গোয়েজে। এক কম্পিউটারের ভাষা অন্য কম্পিউটার বোঝে না। এ দিকে, গবেষণায় এগোতে কম্পিউটারে-কম্পিউটারে যোগাযোগ চাই। নেটওয়ার্ক চাই। তৈরি হল আরপা নেটওয়ার্ক বা আরপানেট। ডলার এল বালিস্টিক মিসাইল গবেষণার বরাদ্দ ছেঁটে। তাতে অস্ত্রবিজ্ঞানীরা চটলেন। ওঁদের শান্ত করা হল এই যুক্তিতে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি হাইড্রোজেন বোমা-সমৃদ্ধ বালিস্টিক মিসাইল ছোড়ে আমেরিকার কোনও শহরে, তা হলে তো একটা জায়গার কম্পিউটার নষ্ট। তথ্য লোপাট। নেটওয়ার্ক থাকলে সে ভয় নেই। বোমা পড়ার আগেই তথ্য শেয়ার করে রাখা যাবে।
১৯৬৯ সালে কম্পিউটার আজকের মতো সর্বব্যাপী হয়নি। তবু, সে দিন ইন্টারনেটের বীজ বপন করে আরপানেট যে প্রেসবিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছিল, তাতে ইউসিএলএ-র প্রফেসর লিয়োনার্ড ক্লেইনরক মন্তব্য করেছিলেন, ‘কম্পিউটার ব্যবস্থা এখন শৈশবে। তা এক দিন বাড়বে এবং ছড়িয়ে পড়বে। হয়তো তখন এসে যাবে অনেক কোম্পানি। যারা আজকের ইলেকট্রিক বা টেলিফোন কোম্পানিগুলোর মতো ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছে কম্পিউটার পরিষেবা।’ মন্তব্য সার্থক। ঘরে ঘরে বিদ্যুতের মতো ইন্টারনেটও তো এখন জলভাত।

তবে, গোলাপেও কাঁটা থাকে যে। ইন্টারনেটের সুফল বোঝাতে অনেকে আরব বসন্ত (এক ঘটনায় বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে রাষ্ট্রপ্রধানের গদিচ্যুতি) কিংবা ওডওয়ার্ড জোসেফ স্নোডেন-এর কৃতিত্বের (আমেরিকা এবং ইউরোপে কোনও কোনও রাষ্ট্রের কুকর্ম) কথা তুলে ধরেন। এখন তো কোনও দামি রেস্তরাঁয় গেলেও মুশকিল। সঙ্গে সঙ্গে আপনার মোবাইলে মেসেজ আসবে: এখানকার খাদ্য ও পানীয়ের আপনি রেট দিতে চান? তা হলে এই নম্বরে দিন।

কিন্তু, এই সব সাফল্যের পাশাপাশি আরও যে অবদান আছে ইন্টারনেটের। নির্বাচনে জালিয়াতি, নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের নজরদারি, ফেক নিউজ়, পর্নোগ্রাফি। ক্লেইনরক প্রথমে ভেবেছিলেন ও সব বিচ্যুতি নেটিজ়েনরা কাটিয়ে উঠবে। তিনি বলেছেন, ‘আগে বলতাম ইন্টারনেট নাবালক বালখিল্যের পর্যায়ে আছে। এখন আর তা বলি না। দেখছি মানুষের নিম্নতম প্রবৃত্তিগুলো প্রদর্শনীর জায়গা হয়েছে ওটা।’

অর্ধশতাব্দী পার করে আজ আমেরিকার মানুষ স্মরণ করছে অনেক কিছু। সত্যি, কত কিছু যে ১৯৬৯ সালে ঘটেছিল ও দেশটায়। জুন মাসে নিউ ইয়র্কে স্টোনওয়াল নামে সরাইখানায় সমকামীদের ওপর পুলিশি হানার প্রতিবাদে দাঙ্গা। জুলাই মাসে চন্দ্রাবতরণ। অগস্টে উডস্টক— চার দিন ব্যাপী গানের জলসা, বৃষ্টি জল কাদা উপেক্ষা করে চার লক্ষ মানুষের উন্মাদনা। অক্টোবরে ইন্টারনেট। প্রথম তিনটের মতন চতুর্থটাও ঐতিহাসিক ঘটনা। তার অভিঘাত প্রথম তিনটেকে অনেক দূর ছাপিয়ে যায়।
স্মৃতি এখনও জাগরূক মানুষের মনে। যে ঘরে বসে চার্লস ক্লাইন ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্ট্যানফোর্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে তাঁর বন্ধু উইলিয়াম ডুভাল-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, সেই রুম নম্বর ৩৪২০— এখন এক মিউজ়িয়াম। রাখা আছে ঠিক যেমনটি ছিল ১৯৬৯ সালে ২৯ অক্টোবর রাতে। ইন্টারনেটের সূতিকাগার হিসেবে দর্শক টানে ওই ঘর। ভাল হোক বা মন্দ, সমাজ বদলের সূচনা ওই ঘরে। তা স্মরণীয় হতে বাধ্য। ব্ল্যাক বোর্ডে আঁকিবুকি এবং মান্ধাতা আমলের এক কম্পিউটারের সামনে দাঁড়িয়ে হয়তো দর্শনার্থীদের মনে পড়ে যায় জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং লেখক কার্ল সাগান-এর কথা। ঠিকই বলেছিলেন তিনি। ‘সায়েন্স ইজ় দি আর্ট অব ম্যানেজিং আওয়ার ফিউচার।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement