চার দিকে গেল গেল রব উঠেছে— নতুন কৃষি আইনে নাকি কৃষকদের খুব ক্ষতি হবে। আদৌ সেই সম্ভাবনা আছে কি? বিতর্কিত তিনটি আইনকে কৃষিক্ষেত্রে উদারীকরণ বলা যেতে পারে— দেশে আর্থিক ক্ষেত্রের উদারীকরণের পর ত্রিশ বছর লাগল এই সংস্কার হতে। আরও অনেক আগেই হতে পারত। এই আইনের মাধ্যমে কৃষিকে বাজারমুখী ও কৃষকদের সরাসরি বাজারের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা হয়েছে; এবং লাল ফিতের দৌরাত্ম্য ও লাইসেন্স-রাজ শেষ করার চেষ্টা হয়েছে।
ভারতে এত দিন নিয়ম ছিল, কোনও কৃষক বা কৃষি উৎপাদক যদি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল বেচতে চান তাঁকে রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রিত এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেটিং কমিটির চত্বরে— চলতি ভাষায় মান্ডিতে— ফসল বেচতে হবে। এই জাতীয় মান্ডি পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যে বেশি দেখা যায়। বাইশটি ফসলের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেওয়া হয়, যার মধ্যে চাল, গম, ডাল অন্যতম। এই সহায়ক মূল্য কৃষকদের কাছে একটা বিমার মতো কাজ করে— কোনও কারণে বাজারে দাম না পাওয়া গেলে মান্ডিতে যে সহায়ক মূল্য পাওয়া যাবেই, এই নিশ্চয়তা থাকে।
যে তিনটি কৃষি আইন পাশ হল, তার মধ্যে প্রথমটি হল দ্য ফার্মার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) অ্যাক্ট, ২০২০। এই আইনে বেসরকারি মান্ডি খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে; কৃষকদেরও অধিকার দেওয়া হয়েছে, তাঁরা যেখানে খুশি সরাসরি খোলা বাজারে কৃষিজাত উৎপাদন বিক্রি করতে পারবেন। আগে বড় কৃষকরা এই স্থানীয় মান্ডিগুলোতেই তাঁদের কৃষিজাত পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হতেন সরকারি লাইসেন্সধারী মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে, ক্রেতাদের কাছে সরাসরি বিক্রির অনুমতি ছিল না। এখন তাঁরা যেখানে ভাল দাম পাবেন, সেখানেই বিক্রি করতে পারবেন। এমনকি অন্য রাজ্যেও সরাসরি বিক্রি করতে পারবেন। এতে বড় কৃষকদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। অন্য দিকে, ছোট কৃষকরা অনেক সময় তাঁদের উৎপাদন সরকারি মান্ডির বাইরেই বিক্রি করেন। তাঁরা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে অত চিন্তিত নন।
পঞ্জাব, হরিয়ানাতে এত বেশি আন্দোলন কেন? এই রাজ্য দু’টিতে প্রধানত গম ও চাল উৎপাদন হয় এবং এই দু’টি ফসলই ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আওতায় আসে। অন্য দিকে, সরকারি কৃষি মান্ডিগুলো থেকে রাজ্য সরকারের প্রচুর কর আদায় হয়। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি— রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক— এগুলির সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গদেরও এগুলি থেকে ভাল কমিশন ও আয় হয়। কৃষকদের থেকে শোষিত টাকাতেই কৃষকদের বিনামূল্যে বিদ্যুৎ দিয়ে ভোট কেনা হয়। বেসরকারি কৃষি মান্ডি এলে প্রতিযোগিতায় এই আয়ের পথ যদি বন্ধ হয়ে যায়? মনে রাখা প্রয়োজন, সরকারি কৃষি মান্ডি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কোনও কথা কিন্তু নতুন আইনে নেই। তাই কোনও কৃষক যদি চান, সরকারি মান্ডিতে যেতেই পারেন, সেখানে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল বেচতে পারেন। তাই সরকারি মান্ডি উঠে যাওয়া, বা সহায়ক মূল্যের সুবিধা না পাওয়ার যে ভয় সমস্ত কৃষককে দেখানো হচ্ছে, তার মধ্যে ক্ষুদ্র স্বার্থ ছাড়া কিছুই নেই।
আর একটি জিনিস ভেবে দেখার: ভারতে এখন প্রয়োজনের অনেক বেশি চাল ও গম উৎপাদন হয়। ফলে অনেক বছর চাল, গম উৎপাদকরা বাজারে ভাল দাম পান না। তখন তাঁরা সরকারি কৃষি মান্ডিতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রি করেন। সেই চাল-গম এফসিআই ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে কিনতে বাধ্য হয়, যেগুলো গুদামে পচছে। জুলাই ২০২০-র হিসেব অনুযায়ী, লকডাউনের সময় বণ্টনের পরেও ১০ কোটি মেট্রিক টনের উপর চাল আর গম ফুড কর্পোরেশনের গুদামে মজুত ছিল। ভারতে চাল ও গমের উৎপাদন আর না বাড়ালেও চলবে। এখন দরকার ভোজ্য তেলের বেশি উৎপাদন, যা ভারতে কম, ফলে আমদানি করতে হয়। কিন্তু পঞ্জাব, হরিয়ানার কৃষকরা চাল আর গম ছেড়ে বেরোতে নারাজ, কারণ সহায়ক মূল্যের নিশ্চয়তা তাঁরা ছাড়তে চান না। এই নিশ্চয়তার আশ্বাস তাঁদেরও উপকার করছে না, দেশেরও না।
দ্বিতীয় আইনটি হল, দ্য ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাশিয়োরেন্স অ্যান্ড সার্ভিসেস অ্যাক্ট, ২০২০। এটি কনট্র্যাক্ট ফার্মিং বা চুক্তি চাষের সঙ্গে যুক্ত। ধরুন, এক আটা প্রস্তুতকারক এক কৃষকের সঙ্গে চুক্তি করল যে, তারা সেই কৃষকের থেকে ছ’মাস পরে ১০০ কুইন্টাল গম কিনবে, এবং তখন কৃষককে কুইন্টাল প্রতি ২২০০ টাকা দাম দেবে। সংস্থাটি কৃষককে উৎপাদনের জন্য অন্যান্য কিছু সাহায্যও করবে, কিন্তু গমের একটি নির্দিষ্ট গুণমান থাকতে হবে। এটাই হল চাষের কনট্র্যাক্ট বা চুক্তি।
এই দাম সাধারণত সংস্থা ও কৃষক আলোচনার মাধ্যমে স্থির করেন। কৃষকের পক্ষে এটি ভাল, কারণ আজ থেকে ছ’মাস পর তাঁর কুইন্টাল প্রতি ২২০০ টাকা দাম পাওয়া নিশ্চিত হল, যা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ১৯৫০ টাকার থেকে বেশি। অতি-উৎপাদনের ফলে খোলা বাজারে যদি দাম পড়েও যায়, তবুও এই কৃষক কুইন্টালে ২২০০ টাকাই দাম পাবেন, অর্থাৎ তাঁর বাজারজাত ঝুঁকি থাকল না। চুক্তিকারী সংস্থাও একটি বিশেষ গুণমানের গম পেল কৃষকের কাছ থেকে, মধ্যস্বত্বভোগীকে কমিশন দিতে হল না।
এই জাতীয় স্বাধীন সরাসরি চুক্তি এখন করা যাবে। কিন্তু, এর জন্য চুক্তিকারী সংস্থাকে ১০০ কুইন্টাল গম মজুত করার স্বাধীনতা দিতে হবে। অত্যাবশ্যক পণ্য আইন দেখিয়ে এটা বলা যাবে না যে, হয় ৫০ কুইন্টাল গম ফেলে দিতে হবে, নয়তো জেল হবে। বাজারকে ঠিকঠাক কাজ করতে দিতে হবে। আর মধ্যস্বত্বভোগীরা, যাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক মদতে পুষ্ট, তাঁরা প্রতিবাদ করবেনই। কারণ, এত দিন তাঁরা যে মুনাফা করতেন, সেটার রাস্তা বন্ধ হচ্ছে। তবে চুক্তি নিয়ে সমস্যা হলে দু’পক্ষকে আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে। তখন বড় সংস্থার আইনি পেশিশক্তি বেশি থাকার সম্ভাবনা।
তৃতীয় আইনটি হল, অত্যাবশ্যক পণ্য আইন (সংশোধন), ২০২০। মূল আইনটি ১৯৫৫ সালের, কিন্তু ঐতিহাসিক ভাবে এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজদের বানানো। এর উদ্দেশ্য ছিল যাতে ভারতীয় কৃষক আর মজুতদাররা কৃষি উৎপাদন জমিয়ে না রাখতে পারেন। এর ফলেই বাংলায় দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যান। এই ইতিহাস অজানা নয়। ভাবতে অবাক লাগে যে, স্বাধীনতার পরেও ভারত সরকার ১৯৫৫ সালে সেই আইন সামান্য বদলে প্রায় হুবহু রেখে দেয়।
কৃষি প্রধানত রাজ্যের বিষয়। বহু রাজ্য সরকারই এই আইনের অপব্যবহার করে। ধরুন, রাজ্যে ভোটের মুখে সরকার এই অত্যাবশ্যক আইন প্রয়োগ করে চালের দাম খুব নিচু স্তরে বেঁধে দিল। কৃষক বাজারে যে দাম পেলেন, তাতে তাঁর উৎপাদনের খরচই উঠল না, তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে গেলেন। সরকারের লাভ হল, কারণ প্রচুর ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা। এই জন্য প্রত্যেক রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে এই আইন সযত্নে লালন করে এসেছে।
নতুন পরিবর্তিত আইনে কখন এই আইন প্রয়োগ করা যাবে, সেটা আরও স্পষ্ট করে বলে দেওয়া আছে। জিনিসপত্রের দাম কতটা বাড়লে তা করা যাবে, এবং কত দিন করা যাবে, তা-ও স্পষ্ট করে বলা আছে। যখন তখন ক্ষুদ্র স্বার্থে এই আইন আর ব্যবহার করা যাবে না। লোকভোলানো রাজনীতির রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে— বিরোধীরা আপত্তি করবেন না?
নতুন সংশোধনে কৃষিজাত পণ্য মজুতের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। আগেই বলেছি, চুক্তি চাষে কোনও বেসরকারি সংস্থা চুক্তি করে যখন বেশ কিছুটা কৃষিজাত পণ্য কিনবে, তারা চাইবে সেটা যাতে তারা হিমঘরে মজুত করে বেশ কিছু দিন ধরে বিক্রি করতে পারে। যদি এই নিশ্চয়তা তাদের দেওয়া না হয়, তা হলে তারা চুক্তি চাষে যাবে কেন? আর চুক্তি চাষ না থাকলে কৃষকদের লাভ হবে কী করে?
কৃষির উদারীকরণ আর্থিক উদারীকরণের মতোই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ, যা ভারতীয় অর্থনীতিকে অন্য স্তরে নিয়ে যেতে পারে। কৃষকরা যাতে বাজার নামক প্রতিষ্ঠানটির সুবিধা পুরোপুরি না পান, সেই প্রচেষ্টা বরাবর করা হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে বাজারকে কখনও পুরো ছাড় দেওয়া হয়নি জনগণের দোহাই দিয়ে। এতে না লাভ হয়েছে জনগণের, না কৃষকদের। মাঝখান থেকে লাভের গুড় খেয়েছে রাজনৈতিক দলগুলি, কিছু ক্ষমতাশালী লোক আর কিছু মধ্যস্বত্বভোগী। তাঁরা তো চাইবেনই যে, পুরনো ব্যবস্থা চলুক। কিন্তু আমরা সেটা হতে দেব কেন?
অর্থনীতি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়