সম্পাদকীয় ১

দোহাই

আসানসোল তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাঁহাদের নিকট কেবল একটিই অনুরোধ করিবেন। প্রাণ যদি সত্যই কাঁদে, তবে যে যাহার আপন নিকেতনে বসিয়া কাঁদিলেই ভাল হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৮ ০০:১০
Share:

সহসা আসানসোলে ভিআইপিদের বান ডাকিয়াছে। মহামান্য রাজ্যপাল ইতিমধ্যে রাঢ়বঙ্গের প্রান্তবর্তী শহরটিতে তাঁহার অভিযান সমাপন করিয়া আসিয়াছেন। তাঁহার এই যাত্রা সরকারের মনঃপূত ছিল না, তাহারা বারংবার অসম্মতি জানাইয়াছিল, কিন্তু রাজভবন কেন বাধ্যতে। ভারতীয় শাসনতন্ত্রে রাজ্যপালের ভূমিকাটি নির্ভেজাল আনুষ্ঠানিকতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। রাজ্য প্রশাসন তাঁহাকে যাহা করিতে বলিবে, তিনি করিবেন, যাহা বলিতে বলিবে, তিনি বলিবেন। তাঁহার নিজস্ব ইচ্ছা বা অভিমত তাঁহার ব্যক্তিপরিসরেই সীমিত থাকিবে, সরকারি কাজে তাহার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন ঘটিবে না। এই সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্যহীনতাই রাজ্যপালের যথার্থ মর্যাদার উৎস। এই বিষয়ে ব্রিটেনের রানি বা রাজার দৃষ্টান্তটিই তাঁহার সর্বতোভাবে অনুসরণীয়। কিন্তু ভারত ব্রিটেন নহে। ফলে রাজ্যপালরা থাকিয়া থাকিয়াই আপন ব্যক্তিত্ব জাহির করিতে ব্যস্ত হন, কেহ কেহ আবার দিল্লির নিয়োগকর্তাদের প্রতি আপন আনুগত্যের প্রমাণ দিতে ব্যগ্র হইয়া উঠেন। আক্ষেপের কথা, শ্রীযুক্ত কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর কর্মপদ্ধতি লইয়াও একাধিক বার প্রশ্ন উঠিয়াছে। আসানসোল সেই প্রশ্নমালায় নূতন সংযোজন।

Advertisement

রাজ্যপাল একাকী নহেন। ভারতীয় জনতা পার্টির রকমারি নায়ক-নায়িকাদের পর্যটন মানচিত্রে আসানসোল সহসা অতীব জনপ্রিয়। চৈত্রের উত্তাপকে কিছুমাত্র পরোয়া না করিয়া তাঁহারা প্রবল উদ্যমে আসানসোল ছুটিতেছেন। রাজ্য সরকারের আপত্তি ও নিষেধবার্তা তাঁহাদেরও দাবাইয়া রাখিতে পারে নাই। ঘটনাচক্রে আসানসোলের সাংসদ বিজেপির সদস্য, তদুপরি কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী। সাংসদ হিসাবে তাঁহার আসানসোল সফরকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলা চলে না, কিন্তু তিনি সেই এলাকার সাম্প্রতিক অশান্তি লইয়া যে-সব মন্তব্য করিয়াছেন, তাহা যদি চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রমাণ না হয়, তবে মানিয়া লইতে হইবে তাহা গভীরতর অভিসন্ধির পরিচায়ক। সাংসদের সফর শেষ হইতে না হইতে ময়দানে নামিয়াছেন তাঁহার এক গুচ্ছ সতীর্থ। রবিবারের সকালে বিজেপির এই জনপ্রতিনিধিরা দল বাঁধিয়া আসানসোলে হাজির হইয়াছেন। উদ্দেশ্য? প্রতিনিধিদলের এক সদস্যের ভাষায়, তাঁহারা সেখানকার উপদ্রুত মানুষের নয়নবারি মুছাইতে গিয়াছিলেন। দুষ্ট লোকে অবশ্য বলিবে, তাঁহারা ঘোলা জলে মাছ ধরিতে গিয়াছিলেন এবং পারিলে, জল আরও কিছুটা ঘোলা করিয়া আসিতে। দুর্জনের কথা শুনিতে নাই। নরেন্দ্র মোদীর অনুগামীদের কথা অবিশ্বাস করিলে মহাপাপ হয়। আসানসোলের জন্য বিজেপি নেতাদের প্রাণ নিশ্চয়ই কাঁদিতেছে।

আসানসোল তথা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাঁহাদের নিকট কেবল একটিই অনুরোধ করিবেন। প্রাণ যদি সত্যই কাঁদে, তবে যে যাহার আপন নিকেতনে বসিয়া কাঁদিলেই ভাল হয়। আসানসোলের মানুষ গত কয়েক দিনে বিস্তর ভুগিয়াছেন, তাঁহাদের অনেকেরই বড় রকমের ক্ষতি হইয়াছে, বেশ কয়েকটি প্রাণ অবধি চলিয়া গিয়াছে। এই বার অনুগ্রহ করিয়া তাঁহাদের ছাড়িয়া দিন। স্থানীয় মানুষ রাজনীতিকদের প্রশ্রয়পুষ্ট দুষ্কৃতীদের আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজস্ব প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছেন, প্রশাসন প্রাথমিক অপদার্থতা কাটাইয়া কিছুটা সক্রিয় হইতে পারিলে সেই চেষ্টা সফল না হইবার কোনও কারণ নাই। বরাবরের মতোই শুভবুদ্ধি কাজ করিতেছে, স্বার্থান্বেষী বিভেদ ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সক্রিয় হইয়াছে জাতিধর্মনির্বিশেষে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক সমন্বয়বোধ এবং শান্তিতে বাঁচিবার বাস্তব প্রয়োজন। সমাজের এই নিজস্ব শক্তিই তাহাকে শেষ অবধি রক্ষা করিবে। চোখের জল মুছিয়া মানুষ আত্মশক্তিতেই উঠিয়া দাঁড়াইবেন। দাঁড়াইতেছেন। আসানসোল স্বাভাবিক হইতেছে। বহিরাগত দুষ্কৃতী এবং বহিরাগত রাজনীতিক, কোনওটিরই প্রয়োজন তাহার নাই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement